বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-১৯

সেই জৌলুস আর নেই

মাহবুব মমতাজী

সেই জৌলুস আর নেই

আজাদ সিনেমা হলের ঐতিহ্য আছে, তবে সেই জৌলুস এখন আর নেই। গত রবিবার বিকালে গিয়ে দেখা গেল, পুরনো একটি ছবি চলছে হলে। ছবির নাম ‘বাঁচাও’। দর্শক তেমন নেই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই পুরনো ছবিগুলোই।

হলের গেটকর্মীরাও আলস সময় পার করছেন। রিয়াল স্টলের সামনে বসে পত্রিকার পাতায় মগ্ন এক কর্মী। প্রক্ষেপণ কক্ষেও ৮৮ বছরের বৃদ্ধের ছাপ। পুরনো দুটি প্রক্ষেপণ যন্ত্র আছে। তবে রিয়ালের বদলে ছবি প্রদর্শনী হচ্ছে পেনড্রাইভ থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে। সিনেমা হলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কান খাড়া করলে শুনতে পাওয়া যায় নায়িকার কান্না-হাসির শব্দ কিংবা ভিলেনের ভয়াল চিৎকার। নায়কের বীরত্বপূর্ণ হাঁক। ৯৩ বছরের পুরনো ভবন এখন আর হলের ভিতরে সাউন্ড আটকাতে পারে না। হলসংশ্লিষ্টরা জানালেন, হলের প্রথম শোর বেশির ভাগ দর্শকই আদালতপাড়ার লোকজন।

একসময় নাগরিকদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল চলচ্চিত্র। ষাট ও সত্তরের দশকে ঢাকার সিনেমা হলগুলোয় দেশ-বিদেশের নতুন, আলোচিত সব চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো। নব্বইয়ের দশকের শেষ প্রান্তে এসে দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্পে মন্দা শুরু হয়। তার প্রভাব পড়ে সিনেমা হলের ব্যবসায়। এই শহরে নব্বইয়ের দশকে অর্ধশত সিনেমা হল থাকলেও কমতে কমতে হলের সংখ্যা এখন ২০-এ এসে ঠেকেছে। কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার জনসন রোডের আজাদ সিনেমা হল। ঐতিহ্যের কঙ্কাল হয়ে এখনো সচল, তবে তার জীবনপ্রদীপ নিবুনিবু করছে। রায়সাহেব বাজার ছেড়ে সদরঘাটের দিকে এগিয়ে গেলে জনসন রোডের মাঝামাঝি হাতের বাঁ পাশে মিলবে হলুদ রঙের ভবনটি। উল্টো দিকে জজ কোর্ট ও ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আজাদ ঢাকার প্রথম দিককার সিনেমা হলগুলোর একটি। এই হলটিই একসময় ঢাকার অভিজাত পরিবারের সদস্যদের বিনোদনের মূল কেন্দ্র ছিল। লেখক, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রের শিল্পী-কলাকুশলীদের পদভারে মুখরিত থাকত আজাদ সিনেমা হল। ঘোড়ার গাড়ি, রিকশায় চড়ে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত। ইংলিশ, উর্দু, হিন্দি, বাংলা ছবিতে বিশ্বকে দেখতেন তারা। আজাদ হলের নাম প্রথমে ছিল মুকুল টকিজ। তখন মালিক ছিলেন মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুল ব্যানার্জি। ১৯২৫ সালে তিনি হলটি নির্মাণ করেন। ১৯২৯ সালে ঢাকায় নির্মিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ এই প্রেক্ষাগৃহে প্রথম মুক্তি পায়। ওই চলচ্চিত্র দিয়েই হলটির যাত্রা। এর উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার (আর সি মজুমদার)। হলটির বর্তমান প্রধান ব্যবস্থাপক এস এম হাসান ১৯৬৪ সাল থেকে চাকরি করছেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ১৯৬৪ সালে মুম্বাইয়ের শের আলী রামজি এ হলটি মুকুল বাবুর কাছ থেকে কিনে নেন। এরপর তিনি এর নতুন নাম দেন আজাদ সিনেমা হল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে ঢাকার এক চলচ্চিত্রপ্রেমী এ ইউ এম খলিলুর রহমান আজাদ সিনেমা হল কিনে নেন শের আলী রামজির কাছ থেকে। খলিলুর রহমানের মৃত্যুর পর এখন তার চার ছেলে এই হলের মালিক। তারা হলেন কলিমুল্লাহ খলিল, ইকবাল খলিল, এরশাদ খলিল ও এজাজা খলিল। আজাদের ৩০ জন থেকে এখন আছেন মাত্র ৮ জন কর্মী। তাদের বেশির ভাগই কৈশোরে যোগ দিয়েছিলেন। এস এম হাসানের সঙ্গে আলাপের সময় তার স্মৃতিতে কড়া নাড়ে ষাট দশকের মুকুল আর আজাদ হল। তখন তিনি তরুণ। ক্রিকেটার ছিলেন। হলের মালিক খলিল সাহেব তার খেলাধুলা খুব পছন্দ করতেন। এজন্য তাকে যথেষ্ট ছাড় দিতেন। ডিউটি করে বেলা ২টায় চলে যেতেন। মায়ায় পড়ে পুরো একটা জীবন আজাদেই পার করে দিলেন তিনি। এখন ছবি দেখতে কেমন দর্শক হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বনেদি পরিবারের কেউ এখন ছবি দেখতে হলে আসেন না। তবে সাড়ে ১২টার শোতে আদালতে আসা লোকজন আসেন বেশি। যেমন অনেকে আদালতে হাজিরা কিংবা সাক্ষ্য দিতে এসেছেন দূরদূরান্ত থেকে। তাদের হাজিরের সময় ৩টা বা তারও পরে। তাই তারা যানজটের এই শহরে একটু আগে-ভাগে এসে হলে ছবি দেখে সময় কাটান। স্মৃতিচারণা করে কলতাবাজারের সফিহ উদ্দিন জানান, প্রতি মাসে নতুন ছবি এলে সবাইকে নিয়ে বাবা হৈহুল্লোড় করে আজাদ হলে ছবি দেখতে নিয়ে যেতেন। আমরা বড় হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যেতাম আজাদ হলে। ছবি দেখা শেষে হলের পাশেই দিল্লি মুসলিম হোটেলে মোগলাই, কাবাব খেতাম। তারপর ফিরতাম বাসায়। সেই ফেলে আসা কৈশোরের দিনগুলো খুব মনে পড়ে। জানা যায়, প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, লেখক সরদার ফজলুল করিম, সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতিচারণায় এই সিনেমা হলে নিয়মিত ছবি দেখার কথা রয়েছে অনেক। পাশেই ছিল ঢাকা আর্ট কলেজ। ছাত্ররা এখানে এসে মানুষের ছবি আঁকতেন। তখন গেট খুললেই হাউসফুল হয়ে যেত। পাঁচটি শ্রেণির আসন ছিল। তৃতীয় শ্রেণিতে ৯ আনা, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১ টাকা এবং প্রথম শ্রেণিতে ছিল ১ টাকা ৩ পয়সা। এ ছাড়া ডিসি ও ব্যালকনিতে যথাক্রমে ৩ টাকা ও ২ টাকার টিকিট ছিল। আজাদ হলের মূল প্রতিষ্ঠান দি ঢাকা পিকচার প্যালেস লিমিটেড। এ হলে সুজন-সখী, অবুঝ মন, বউ কথা কও, সারেং বউ, ছুটির ঘণ্টা, অশিক্ষিত, ডাকু মনসুর, মহানগর, সাম্পানওয়ালা ও জনতা এক্সপ্রেসের মতো কালজয়ী ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, মূল ভবনসহ ভিতরের অফিস কক্ষগুলো আগের মতোই আছে। কর্মচারী ইউনিয়নের কক্ষে সাইনবোর্ড আছে। কিন্তু ভিতরে ফাঁকা। ষাট দশকের শুরুতে এই ইউনিয়ন গঠিত হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর