শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

রিয়াল হলো লুঙ্গি-গামছা

মির্জা মেহেদী তমাল

রিয়াল হলো লুঙ্গি-গামছা

রংপুর শহরের একটি মসজিদের ইমাম শরিফুজ্জামান (ছদ্মনাম)। এক বিকালে মধ্যবয়সী এক লোক আসেন তার কাছে। নামাজ শেষে তার সঙ্গে কথা বলেন। নানা আলোচনায় তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়। লোকটি মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। ইমামকে বলেন, তিনি মসজিদের মাদ্রাসায় ১ লাখ টাকা দান করবেন। শুনে ইমাম শরিফুজ্জামান ভীষণ খুশি। প্রায় প্রতিদিনই সেই লোকটি আসেন ইমামের কাছে। কথা বলেন।

 ধীরে ধীরে বিশ্বস্ততা অর্জন করেন। এরই মাঝে লোকটি ইমামকে বলেন, ‘হুজুর! আমার কাছে বাংলাদেশি টাকায় ৫ লাখ টাকার মতো বিদেশি রিয়াল আছে। কিন্তু সেগুলো ভাঙাতে পারছি না। কারণ, ব্যাংক থেকে সৌদি রিয়াল ভাঙাতে গেলে যে ভিসা দরকার, তা আমার নেই। আপনি একজন সুফি মানুষ। শুনেছি মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন। তাই আপনার সাহায্য দরকার। রিয়াল ভাঙাতে পারলে ১ লাখ টাকাও আমি দিতে পারব।’ ইমাম শরিফুজ্জামান কিছুক্ষণ ভাবেন। কিছু লাভের আশায় তিনি রাজি হয়ে যান। কয়েক দিনের মধ্যেই ৫ লাখ টাকা ম্যানেজ করলেন ইমাম। সেই লোকটি নির্ধারিত দিনে আরও কয়েকজন লোকসহ সুন্দর করে একটি কাপড়ের পোঁটলা বানিয়ে তার মধ্যে বিদেশি রিয়াল নিয়ে এলেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ইমাম একটি অটোতে উঠলেন। সঙ্গে ওই লোকসহ আরও দুজন। অটোতে বসেই লোকগুলো সেই কাপড়ের পোঁটলার ভিতর থেকে ইমামকে কয়েকটি বিদেশি রিয়ালের নোট বের করে দেখিয়ে বলেন, ভিতরে সবই রিয়াল। ইমাম বললেন, ঠিক আছে অসুবিধা নেই। যেহেতু আশপাশে লোকসমাগম বেশি তাই এভাবে সব রিয়াল বের করতে বারণ করলেন তারা ইমামকে। ইমাম অটোতে বসেই টাকা আর বিদেশি রিয়াল রাখা কাপড়ের ব্যাগের পোঁটলা হাতবদল করে নিলেন। কিছুক্ষণ পর লোকগুলো ইমামকে সালাম দিয়ে অটো থেকে নেমে যান। ইমাম রিয়ালসহ কাপড়ে মোড়ানো পোঁটলা নিয়ে বাসায় চলে এলেন। ইমামের এইটুকু বিশ্বাস ছিল যে, যেহেতু তার মোবাইল ফোন নম্বর তার কাছে আছে তাই কোনো প্রকার দুই নম্বরির সুযোগ নেই। কারণ, মোবাইলের সূত্র ধরে তাকে বের করা সম্ভব। বাসায় এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ইমাম যখন কাপড়ের পোঁটলাটি খুললেন তখন তার মাথায় হাত। আকাশ যেন ভেঙে পড়ল। পোঁটলায় কোনো সৌদি রিয়াল নেই। যা আছে তা হচ্ছে একটি বিছানার চাদর, একটি লুঙ্গি আর গামছা; যা সুন্দর করে ভাঁজ করে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে বিদেশি রিয়ালের ৫ লাখ টাকার পোঁটলা তৈরি করা হয়। সেই পোঁটলা ইমামকে বুঝিয়ে দিয়ে ৫ লাখ টাকা নিয়ে চম্পট! বুঝতে পারেন, প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন তিনি। তত্ক্ষণাৎ ইমাম ওই প্রতারকের নম্বরে কল দেন। অন্য প্রান্ত থেকে বলা হলো, দুঃখিত, আপনি যে নম্বরটিতে কল করেছেন তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। নম্বরটি সেই যে বন্ধ হয়েছে এখনো বন্ধ। আর কোনো দিন চালু হবে কিনা কেউ বলতে পারে না। পুলিশকে জানান ইমাম। পুলিশ এখনো খুঁজে পায়নি সেই চক্রকে। ঘটনাটি কয়েক দিন আগের। জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান।

এ ঘটনাটিও রংপুরের। ওপরের ঘটনার কয়েক দিন পরই ঘটে। ঘটনার ভুক্তভোগী একজন ব্যবসায়ী। হঠাৎ একদিন অপরিচিত এক ব্যক্তি একজন বিদেশিসহ তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এসে হাজির হন। তিনি জানান, বিদেশি ভদ্রলোক রংপুরে একটি ইন্ডাস্ট্রি করতে জমি খুঁজছেন। তিনি যদি তাকে সহযোগিতা করেন তাহলে লাভবান হবেন। তিনি তাকে বোঝালেন, বিদেশিকে ভুলভাল বুঝিয়ে জমির দাম কমবেশি করে বিদেশির কাছ থেকে অনেক টাকা হাতিয়ে নেওয়া যাবে। কথামতো কাজ শুরু হলো। এবার টাকা লেনদেনের সময় এলো। বিদেশিসহ অপরিচিত লোকটি ব্যবসায়ীর বাসায় যান। অপরিচিত লোকটি ব্যবসায়িকে আশ্বস্ত করলেন যে তারা ১৫ কোটি টাকা মূল্যমানের ডলার নিয়ে আসছেন এবং তার পুরোটাই তার কাছে রেখে যাবেন। বিনিময়ে তাকে ৩০ লাখ টাকা আপাতত জোগাড় করে দিতে হবে। বাদবাকি টাকা জমির কাগজপত্র করার সময় হিসাব-নিকাশ করা হবে। ব্যবসায়ী দুই দিনের মধ্যে ২৮ লাখ টাকা জোগাড় করলেন। তাদের কথামতো সবই ১ হাজার টাকার নোট। নির্ধারিত দিনে বিদেশিসহ অপরিচিত লোকটি আবারও ব্যবসায়ীর রংপুরের বাসায় এলেন। ব্যবসায়ীর সামনে বিদেশি লোকটি তার সঙ্গে নিয়ে আসা ১৫ কোটি টাকা মূল্যমানের ডলারের বাক্স থেকে দুটো নোট বের করলেন। সেই নোট দুটি ব্যবসায়ীর হাতে দিলেন। ব্যবসায়ী ডলার ভাঙিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন ডলার আসল। এবার ব্যবসায়ীর ২৮ লাখ টাকার নোটগুলো সেই অপরিচিত লোকটি সাদা স্কচটেপ দিয়ে খুব সুন্দর করে পেঁচিয়ে নিলেন। আর তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা ১৫ কোটি টাকা মূল্যমানের বিদেশি ডলারের বিশেষ বাক্সটি ব্যবসায়ীর হাতে দিয়ে বললেন, এসবই আপনার কাছে থাকুক। আমরা পরদিন এসে বাদবাকি কাজ করব। ব্যবসায়ী তো মহাখুশি। এমন সহজ-সরল মানুষ এই দেশে কজন আছে! সেখানে আবার বিদেশি বলে কথা। মহাখুশি মনে ব্যবসায়ী লোকটি বিদেশিদের আপ্যায়ন করে বিদায় দিলেন। আর রুমে এসে টাকা এবং ডলারের বিশেষ সুরক্ষিত বাক্সটি আলমারিতে যত্ন করে রাখলেন। অপরিচিত লোকটি ঢাকায় গিয়ে পরদিন ব্যবসায়ীকে ফোন দিলেন। বললেন, ইমারজেন্সি ৩ লাখ টাকা লাগবে এবং দ্রুত বিকাশে ওই টাকা পাঠাতে বলেন। এমন বিশ্বস্ত মানুষের ডাক পেয়ে কি বসে থাকা যায়! আশপাশের যত বিকাশ এজেন্টের দোকান ছিল, সবার দোকান থেকে বিভিন্ন নম্বরে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাঠালেন। এর ঠিক এক দিন পরই ব্যবসায়ী লোকটি যখন সেই অপরিচিত লোকটিকে ফোন দিলেন, দেখতে পেলেন নম্বরটি বন্ধ। ভাবলেন হয়তো অন্য কোনো কারণে নম্বরটি বন্ধ আছে। ঠিকই নম্বর খুলবে। কিন্তু তিন দিন পার হয়ে যায় নম্বর আর চালু হয় না। আর তার কাছে রাখা ১৫ কোটি টাকা মূল্যমানের বিদেশি ডলারেরও কোনো খোঁজ কেউ নেয় না।

বেশ ভাবনার মধ্যে পড়ে যান ব্যবসায়ী লোকটি। এতগুলো ডলার কী করবেন! কাউকে জানাবেন! নাকি একা একাই সেগুলো নিয়ে নেবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে, সেদিন তার ২৮ লাখ টাকার যে প্যাকেটটি তারা স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে প্যাকেট করেছিল, সেটি কৌশলে সরিয়ে অন্য একটি অনুরূপ প্যাকেট তাকে দিয়ে গেছে। সেই বিদেশি ও অপরিচিত লোকটির সঙ্গে প্রায় বেশ কিছুদিন যাবৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর নিরুপায় হয়ে ব্যবসায়ী লোকটি তার ২৮ লাখ টাকার স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো প্যাকেটটি খোলেন। ব্যবসায়ী লোকটির সেই স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো প্যাকেটে কোনো টাকা ছিল না। যা ছিল সবই এক ধরনের কালো কাগজ। আর অপরিচিত লোকটির রেখে যাওয়া ১৫ কোটি টাকা মূল্যমানের বিদেশি ডলারের বিশেষ বাক্সটি বহু কষ্ট করে ভাঙার পর সেখানেও পাওয়া গেল একই ধরনের এক ধরনের বিশেষ কালো কাগজ। এসব দেখেই তত্ক্ষণাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন ব্যবসায়ী। তাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।

ওই সময়ে রংপুরে এ দুটি ঘটনার তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সালেহ ইমরান বলেন, দুটো ঘটনার ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, অপরিচিত লোকদের কোনো প্রকার পরিচয় না জেনে তাদের এভাবে বিশ্বাস করার কারণ কী? উত্তরে জানিয়েছিলেন তাদের ফোন নম্বরের কথা। তাদের ধারণা, ফোন নম্বর যেহেতু আছে সেহেতু পরিচয় গোপন করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, তারা যেমন আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ফোন নম্বর নিবন্ধন করেছেন, এ রকম তো সবাই করেছেন। কিন্তু এখন তো ক্লোনিং হতে পারে নম্বর। অন্য কারও নম্বর ব্যবহারও করতে পারে প্রতারক চক্র। যে কারণে এভাবে অপরিচিত লোকের সঙ্গে লেনদেনে যাওয়াটা ঠিক নয়।

 তিনি বলেন, আর শুধু মোবাইল নম্বরের পরিচয় দিয়ে কারও সঙ্গে কোনো প্রকার লেনদেন করবেন না। লেনদেন করার সময় অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে আপনার প্রাপ্য দেখে শুনে বুঝে নেবেন। বড় কোনো লেনদেনের ক্ষেত্রে পরিচিতজনের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। লোভে পড়ে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন অথবা নিজেকে অন্যের চেয়ে চালাক ভাবলে পুরস্কার হিসেবে কপালে এ রকম দুর্গতি ছাড়া কিছুই জুটবে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর