বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
নিউইয়র্কের চিঠি

দেয়াল বনাম সেতু এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি

শামীম আল আমিন

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসন নীতিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে চান। সুযোগ পেলেই তিনি বাতিল করে দিতে চান ‘চেইন মাইগ্রেশন’ পদ্ধতি। এ ব্যবস্থার সরাসরি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশের নাগরিকের ওপর। কেননা এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে, টেবিলে রাখা একটি প্রস্তাব অনুযায়ী কেবল স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের মাইনর চাইল্ড অভিবাসী হয়ে আসতে পারবে। বর্তমানে চালু থাকা বাবা-মা, ভাই-বোনসহ নিকট স্বজনরা আর আমেরিকায় আসতে পারবে না। ফলে কোনো দম্পতির সাবালক হয়ে যাওয়া সন্তান পর্যন্ত বাবা-মায়ের কাছে থাকতে পারবে না। দাদা-দাদি, নানা-নানী কিংবা ভাই-বোন তো তখন অনেক দূরের ব্যাপার হয়ে যাবে। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘ডাইভারসিটি বা ডিভি লটারি’ কর্মসূচিও তুলে দিতে চান। বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডিভি লটারি চালু না থাকলেও, বেশ কয়েকটি দেশে তা রয়েছে। এই কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল, যেসব দেশের নাগরিক আমেরিকায় কম আসার সুযোগ পেয়েছে, সেসব দেশ থেকে লটারির মাধ্যমে লোক নিয়ে আসা। অতীতে বাংলাদেশ থেকেও এ কর্মসূচির মাধ্যমে অনেকে আমেরিকায় এসেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করেন, অভিবাসনের ক্ষেত্রে লটারি কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না। তিনি চান পুরো অভিবাসন পদ্ধতি হবে মেধাভিত্তিক। এ ধরনের ব্যবস্থা কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়াসহ কিছু দেশে চালু রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন ভাবনা নিয়ে মূলত কাজ করছেন রক্ষণশীল দুই রিপাবলিকান সিনেটর আরাকানসাসের টম কটন এবং জর্জিয়ার ডেভিড আলফ্রেড পারডু। যারা বিষয়টি নিয়ে বেশ সোচ্চার। তবে পুরো বিষয়টি এখনো রয়েছে কেবল আলোচনার পর্যায়ে। 

একদিকে যেমন অভিবাসন ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের চিন্তা, অন্যদিকে ‘ডাকা’ কর্মসূচির মধ্যে থাকা প্রায় আট লাখ তরুণের জীবনে অনিশ্চয়তার অন্ধকার কাটছে না। ‘ডেফার্ড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভালস’ বা ডাকা কর্মসূচিটি ২০১২ সালের জুন মাসে চালু করেছিলেন তখনকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। শৈশবে বাবা-মায়ের হাত ধরে অবৈধভাবে আমেরিকায় আসা তরুণরা এ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে বলা হয় ‘ড্রিমার’। প্রথম থেকেই ডাকা কর্মসূচি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান বলা যায় ‘মিশ্র’। শুরুতে এ নিয়ে তিনি ইতিবাচক কথাই বলতেন। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের বেশি সময় পরও ‘ডাকা’ কর্মসূচি নিয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি। বরং স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। যা নিয়ে এখনো রাজনীতির মাঠ গরম করছে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ডাকা’ কর্মসূচির সমাপ্তিও ঘোষণা করেছেন। ড্রিমারদের ভাগ্য নির্ধারণের ভার তিনি তখন কংগ্রেসের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। ট্রাম্প তখন বলেছিলেন, কংগ্রেস কিছু করতে না পারলে, পরে তিনি বিষয়টি আবারও মূল্যায়ন করবেন। অথচ ড্রিমারদের পক্ষে ডেমোক্রেটদের দৃঢ় অবস্থানের পরও দ্বিদলীয় রাজনীতিতে বিষয়টির সুরাহা এখনো কিছু হয়নি। এমনকি এ নিয়ে সরকার ‘শাট ডাউন’ বা ‘অচল হয়ে যাওয়ার’ মতো ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যে ৫ মার্চ ডাকা কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। নিবন্ধিত ৮ লাখ ড্রিমারের স্বপ্ন এখন বেঁচে আছে আদালতের রায়ে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থায়ী সমাধানে কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্টকে তো কিছু একটা করতে হবে।  চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম আনুষ্ঠানিক ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণে বলেছিলেন, কেবল নিবন্ধিত ৮ লাখ ড্রিমার নয়, এর বাইরে থাকা মিলিয়ে প্রায় ১৮ লাখকে তিনি বৈধতা দিতে চান। এমনকি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ১২ বছরের মধ্যে তারা দেশের নাগরিকও হতে পারবেন। কিন্তু তিনি শর্ত জুড়ে দেন, এর বিনিময়ে পুরো অভিবাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সেই সঙ্গে দিতে হবে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের অর্থ। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেশটির অবস্থা কী দাঁড়িয়েছিল, বিশেষ করে অভিবাসীদের ক্ষেত্রে; তা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যাননি। হঠাৎ করেই বদলে যাওয়া সময়ে যেন দমকা হাওয়াই বয়ে যাচ্ছিল। চারদিকে এলোমেলো, অস্থিরতা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামল পেরিয়েছে, এক বছরের কিছুটা বেশি সময়। অভিবাসীদের ক্ষেত্রে অবস্থা বদলায়নি। বদলেছে কেবল ধরন। উপরে উপরে সব কিছু শান্ত মনে হলেও ভিতরে ভিতরে আছে নানান তৎপরতা।

শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এনে, অভিবাসন প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানোর কথা বলে আসছেন। এ নিয়ে একের পর এক, বেশ কিছু সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়েছেন। নির্বাহী আদেশে মুসলিম প্রধান কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে সাময়িক নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছিলেন। যা গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত, পেরিয়েছে নানান পথ। অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে সীমান্তে কড়াকড়ি করেছেন। বেড়েছে ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট-আইস এর তৎপরতা। প্রচুরসংখ্যক অবৈধ মানুষকে নিয়মিত ডিপোর্ট করছে সংস্থাটি। যার মধ্যে কাগজপত্রহীন বাংলাদেশিরাও রয়েছেন। যদিও বলা হয় প্রেসিডেন্ট ওবামার সময়ও অনেক অবৈধ অভিবাসীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তখন আলোচনা কম হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, ওবামা ডেমোক্রেট এবং তিনি অভিবাসন বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করে এটিকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে যাননি। তাছাড়া অবৈধদের ফেরত পাঠানো একটি স্বাভাবিক আইনি ও নিয়মিত প্রক্রিয়া। অথচ ট্রাম্পের সময়ে বিষয়টি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, মানবিক আবেদনের বিষয়টি সামনে আসছে বারবার। এমনকি অনেকে কাগজপত্রহীন মানুষগুলোর পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েও যাচ্ছেন। কারণ হিসেবে অভিবাসন বিষয়ে প্রেসিডেন্টের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কথাই বলছেন বিশ্লেষকরা।

শুরু থেকেই এদেশেরই অনেক মানুষকে পাওয়া যাচ্ছে অভিবাসী ও শরণার্থীদের পাশে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেয়াল নির্মাণ করতে চান; আর প্রতিবাদী মানুষগুলো সেতু তৈরির পক্ষে। ফলে ‘দেয়াল বনাম সেতু’ অদৃশ্য একটা লড়াই সেই থেকে চলছে। এমনকি মানবিক ও বিবেকবান হাজারো মানুষ প্রতিবাদে নেমে এসেছে রাস্তায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো যাদের জীবনে সরাসরি কোনো প্রভাব ফেলেনি, দেশটির এমন অনেক সচেতন নাগরিকও সোচ্চার। যারা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলোকে দেখেননি, বর্ণের ব্যাখ্যাতেও যাননি। নানান ধর্মের অনেক মানুষকে, সেসব প্রতিবাদে শামিল হতে দেখা গেছে। এসব সমাবেশ থেকে উচ্চারিত হয়েছে, ‘টুডে আই অ্যাম মুসলিম ঠু’, ‘টুডে আই অ্যাম ইমিগ্র্যান্ট ঠু’, ‘টুডে আই অ্যাম রিফিউজি ঠু’। ভেবে দেখুন কতটা হৃদয়বান এদেশের সাধারণ মানুষ। 

অভিবাসীদের বিষয়ে, প্রেসিডেন্ট ‘এক্সট্রিম ভেটিং’য়ের ব্যবস্থা করেছেন। কড়া নজরদারি চলছে। নানা কারণে আশ্রয় প্রার্থী মানুষদের বিষয়ে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে যেন কেউ অবৈধভাবে ঢুকে পড়তে না পারে, সে জন্য বাড়তি ব্যবস্থা নিয়েছেন। অনেক আলোচনা-সমালোচনার পরও মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের সিদ্ধান্তে অনড় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সম্প্রতি সীমান্তে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তও দিয়েছেন তিনি। এসব কিছুর পেছনে যুক্তি দেখানো হচ্ছে, ‘দেশের নিরাপত্তা’, ‘স্থিতিশীলতা’ এবং কর্মসংস্থানের পরিবেশ ঠিক রাখার মতো বিষয়কে।  দেশের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে। এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে শতভাগ সহমত রয়েছে আমার। কোনোভাবেই যেন কোনো সন্ত্রাসী সুন্দর এই দেশটাতে ঢুকে পড়তে না পারে, কোনোভাবেই আগে ঢুকে পড়া কোনো ব্যক্তি যেন দেশটির সামান্যতম ক্ষতি করতে না পারে, সে চেষ্টা নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হবে। এতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে অভিবাসীদের দায়িত্ব হবে নিজেরা যেন কোনো অবস্থাতেই ‘উগ্রপন্থায়’ জড়িয়ে না পড়ে। বরং নিজ নিজ অবস্থান থেকে এসব উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। তাদের পরিচয়; তারা সন্ত্রাসী। তবে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীকে দমন করতে গিয়ে নিরপরাধ কোনো মানুষ কিংবা গোষ্ঠী যেন ‘অন্যায়’ কিংবা ‘অন্যায্য’ আচরণের শিকার না হয়; সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আর কেবল ‘বিশেষায়িত’ কোন ইস্যুকে সামনে না এনে, সব ধরনের অপরাধকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে এবং তা প্রতিহত করতে হবে। ভেবে দেখতে হবে যারা দেশটিকে ভালোবেসে, দেশের আইনের প্রতি, সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আস্থা, সম্মান নিয়ে দেশটিকে থাকতে চান; অভিবাসন ব্যবস্থা কঠোর হলে, তার প্রভাব তাদের ওপরও পড়ে। নিয়মতান্ত্রিক অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষের জীবনেও নেমে আসে গভীর অনিশ্চয়তা। নেমে আসে বিষণ্নতার অন্ধকার। লেখক : হেড অব নিউজ, টিবিএন২৪ টেলিভিশন, নিউইয়র্ক। [email protected]

সর্বশেষ খবর