মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

টিকে আছে চিত্রা সিনহার হল

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-২৬

মাহবুব মমতাজী

টিকে আছে চিত্রা সিনহার হল

ঐতিহ্যের ছোঁয়া চিত্রামহলের সবখানে। পুরনো নকশার দোতলা ভবন। দুই পাশে দুটি ছোট বারান্দা। পেঁচানো সিঁড়ি। মূল দরজার ওপরে লম্বা ও পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা। ঢুকতেই মাথার ওপরে সহজে চোখে পড়ে ছবির নাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটিও চিত্রামহলের একটি ঐতিহ্য। বড় একটি ব্যানারে শুধু পরিচালক, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানসহ সিনেমার নাম থাকে। কর্তৃপক্ষ নিজেরা ডিজাইন করে এগুলো করান। যেখানে শিল্পী কিংবা সিনেমার কোনো দৃশ্য থাকে না। এটি পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার কাজী জহিরের স্মৃতিবিজড়িত চিত্রামহলের বর্ণনা। গুলিস্তান থেকে নর্থসাউথ রোড ধরে সদরঘাট  যেতে ইংলিশ রোডের মুখেই চিত্রামহল। সারা দেশে হল ব্যবসায় যখন মন্দা তখন মাত্র ১৪ জন কর্মী নিয়ে গতকালও চিত্রামহলে চলছিল ‘বিজলী’ নামের একটি ছায়াছবি। খুব একটা বড় নয় চিত্রামহল হল। নিচতলায় ঢুকেই টিকিট কাউন্টার। তিন ক্যাটাগরিতে ছবি দেখার ব্যবস্থা। সাগর, ঝিনুক, শাপলা। কাজী জহিরের তিন সন্তানের নামে এই তিন ক্যাটাগরি। মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত লোকজনই এখানকার দর্শক। তাঁতীবাজার, জিন্দাবাহার, বংশাল, সদরঘাট, নয়াবাজার, ইংলিশ রোড, নবাবপুর, কলতাবাজার, রায়সাহেব বাজার, ধোলাইখাল এলাকা থেকে এখনো মানুষ আসে এই হলে ছবি দেখতে। দোতলায় অপেক্ষা করার জন্য আছে বসার জায়গা। সোফা ও চেয়ারগুলো বেশ পুরনো। আগের মতো সেখানে বসার কোনো লোক নেই। পুরনো হলেও মেঝেটা ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন। দেয়ালে ঝোলানো পুরনো দিনের নামকরা অনেক ছবির পোস্টার। তালিকাটা তাক লাগানোর মতো। একেকটি ছবি যেন ইতিহাস। ময়নামতি, অবুঝ মন, বধূ বিদায়, নয়ন তারা, ফুলের মালা, মধু মিলন, কথা দিলাম। বাংলা ছবির সোনালি যুগের অনেক কালজয়ী ছবির সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের সংযোগ আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এ প্রতিষ্ঠান ও কাজী জহিরের সবকটি সিনেমার নাম বাংলা পাঁচ অক্ষর দিয়ে। জানা যায়, মৃত্যুর আগে কাজী জহির হলটির পরিসর বাড়ানোর চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু একটা সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তা আর করতে পারেননি। ১৯৯২ সালে তিনি মারা যাওয়ার সময় সিনেমা হলটি যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে। কোনো কিছুর পরিবর্তন করা হয়নি। মাঝে ডিজিটাল পর্দা ও প্রক্ষেপণের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে প্রক্ষেপণ ঘরটিতে আগের মেশিনটি এখনো আছে।

হলটির বর্তমান মহাব্যবস্থাপক ইকবাল ইউসুফ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা কাজী জহিরের স্মৃতিতে হলটি টিকিয়ে রেখেছি। আমাদের হলটি বাংলাদেশের সুস্থ চলচ্চিত্রের পুরোধা। আমরা ফিল্ম থেকে সরতে পারি না, কারণ আমাদের রক্তে ফিল্ম। তাই প্রতি মাসে মালিক ভর্তুকি দিয়ে হলেও হলটি চালাচ্ছেন। দেশের নামকরা ১০টি ছবির মধ্যে দেখা যাবে ৩টিই আমাদের প্রোডাকশনের।’ তিনি আরও জানালেন, ‘কাজী জহিরের স্ত্রী চিত্রা জহির এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। সেখান থেকে খোঁজখবর রাখেন। এখন তো ছবির বাজার আগের মতো নেই। তবে আমাদের সাউন্ড আর পর্দা মধুমিতার মতোই। আমার চাচা (কাজী জহির) পর্দা ও শব্দের ব্যাপারে সবসময় সচেতন ছিলেন। ছবির বিষয়ে ছিলেন খুব খুঁতখুঁতে। একটি ছবি মুক্তির পর আমরা দেখেছি কোথায় ভুল আছে, কোথায় দুর্বলতা আছে, এসব নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষা দিতে হতো তার কাছে। তিনি সবসময় সুস্থধারার ছবির পক্ষে ছিলেন। হুজুগের সঙ্গে তাল মেলাননি।’ জানা যায়, ঢাকার প্রথম ১০টি সিনেমা হলের অন্যতম এটি। আগে এই হলের নাম ছিল নাগরমহল। তাঁতীবাজারের ব্যবসায়ী নাগর পোদ্দার চালু করেছিলেন এই হল। ধারণা করা হয়, নাগর পোদ্দার ব্রিটিশ শাসনামলে হলটি চালু করেন। আর চিত্রামহল হয়েছে ১৯৮৩ সালে। আগে এই হলে হিন্দি, উর্দু ছবি চলত। মুক্তিযুদ্ধের পর এটি দীর্ঘদিন শত্রু সম্পত্তি হিসেবে সরকারের তত্ত্বাবধানে ছিল। হলটি বিক্রির কথা উঠলে শুরুর দিকে তেমন কেউ এগিয়ে আসেনি। কেননা সামনে খাল, রাস্তা বলতে এখন হলের সামনে যে রাস্তাটি আছে সেটিই ছিল। অর্থাৎ ধোলাইখালের অংশ। তখন কাজী জহির প্রতিষ্ঠিত পরিচালক, প্রযোজক। ভালো ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও ইংরেজিতে ডাবল এমএ করে নটর ডেম কলেজে শিক্ষকতা করেন। তার চলচ্চিত্রের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। তাই তিনি শিক্ষকতা থেকে বিদায় নিয়ে সিনেমা পরিচালনায় লেগে যান। যোগ্য লোক হিসেবেই কাজী জহির হলটির দায়িত্ব নেন। তিনি পুরনো নাম পরিবর্তন করে স্ত্রী তৎকালীন অভিনেত্রী চিত্রা সিনহার নামে হলের নাম রাখেন চিত্রামহল। স্মৃতিচারণায় বুলবুল নামে এক কর্মী জানালেন, ‘প্রথম দিন থেকে এ হলের সাড়া পড়ে যায় চারদিকে। তখন কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করা কঠিন ছিল। যে কোনো ছবির টিকিট ব্ল্যাকে বিক্রি হতো। এমনকি সন্ধ্যার পরও মহিলারা দল বেঁধে বোরকা পরে ছবি দেখতে আসতেন।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর