মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্থগিতাদেশে আটকে আছে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বিচার

আরাফাত মুন্না ও তুহিন হাওলাদার

সাভারের রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। এ ঘটনায় সাভার থানায় দায়ের হওয়া তিনটি মামলার মধ্যে দুটিতে (হত্যা ও ইমারত) অভিযোগ (চার্জ) গঠিত হয়েছে দুই বছর আগে। তবে উচ্চ আদালতে এ দুই মামলার ওপর স্থগিতাদেশ থাকায় বিচার শুরু করা যাচ্ছে না। এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে রাষ্ট্রপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের কারোই কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। এ ছাড়া দুই মামলায় অধিকাংশ আসামিই জামিনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় অনিয়ম ও অবহেলার কারণে শ্রমিকদের মৃত্যুর অভিযোগে ওই ভবনের মালিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে আসামিপক্ষের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি দুটি মামলা স্থগিত করে হাই কোর্ট। এর ফলে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন দুটি মামলার প্রতিটি ধার্য তারিখে সাক্ষী হাজির করা হলেও সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। আগামী ১৫ মে পর্যন্ত স্থগিতাদেশ রয়েছে মামলা দুটিতে। স্থগিতাদেশের মেয়াদ বৃদ্ধি না হলে ১৬ মে ধার্য তারিখেই বিচার শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় তিনটি মামলার মধ্যে ভবন ত্রুটিপূর্ণ জেনেও শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলা করে পুলিশ। সরাসরি হত্যার অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন নিহত শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলী আক্তার ও বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করার অভিযোগে ইমারত আইনে মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তিনটি মামলার মধ্যে পুলিশের ও শিউলী আক্তারের মামলা দুটি একসঙ্গে এবং অন্যটির আলাদা তদন্ত হয়েছে। রানা প্লাজা নিয়ে করা এসব মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খন্দকার আবদুল মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা হত্যা মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। বিচারের জন্য আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত; কিন্তু সাত আসামির করা রিটে গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টে স্থগিত হয়ে যাওয়ায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী ১৬ মে এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে। আশা করছি এই সময়ের আগেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে।’ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার ছাড়া বিচার শুরু করা সম্ভব নয় বলে জানান এই আইনজীবী। তিনি আরও বলেন, এটা আর দশটা হত্যা মামলার মতো নয়। প্রত্যক্ষভাবে কেউ কাউকে হত্যা করেনি। কতগুলো মানুষের বাড়াবাড়ির কারণে সেদিন এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। মামলার অভিযোগপত্রে প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। তাই কারও অব্যাহতি পাওয়ারও সুযোগ নেই। এর পরও আসামিপক্ষ অযথা হাই কোর্টে গিয়ে সময় নষ্ট করছে। স্থগিতাদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতের আইনজীবী (পিপি) বিষয়টি যদি আমাদের নজরে আনেন, তখনই আমরা এ ব্যাপারে আদালতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। যখনই অবহিত করবেন তখনই আইন কর্মকর্তারা যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।’ তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের কাছ থেকে আমাদের শুনতে হয় ওই মামলায় স্থগিতাদেশ রয়েছে। আইনজীবীরা তো জানান না।’ আসামিদের জামিনে থাকার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘জামিনের বিষয়ে আমরা উচ্চ আদালতে গিয়েছিলাম। আদালত কারও জামিন বহাল রেখেছে, আবার কারও জামিন বাতিল করেছে।’

মামলার সারসংক্ষেপ : নথি থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের আলাদা দুই মামলায় ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দুই মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আবদুল খালেক ওরফে খালেক কুলুসহ ৫৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে আসামির মধ্যে ১৭ জনের নাম উভয় মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকায় ব্যক্তি হিসেবে আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ৫৯৪ জনকে। এ ছাড়া ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ১৩৫ জনকে। এ দুই মামলার মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ আসামির মধ্যে দুই আসামি মারা যাওয়ায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৯। এ মামলায় সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেক ওরফে খালেক কুলুসহ ৩০ জন জামিনে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন সাত আসামি। পলাতকদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। এ ছাড়া সোহেল রানাসহ তিন আসামি কারাগারে বন্দী রয়েছেন। অন্যদিকে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ আসামির মধ্যে সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেক ওরফে খালেক কুলুসহ ১২ জামিনে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন তিনজন।

ফিরে দেখা ট্র্যাজেডি : ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে নয় তলাবিশিষ্ট রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ঢাকা জেলা প্রশাসক অফিসে রক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত ও ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যান। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৬ জন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পাবনার বেড়ায় রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক আবদুস সোবহান মারা যান।

ভবনধসের ঘটনায় আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ আদালতের নির্দেশে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার ব্যক্তিগত সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সরকার। ধসের ঘটনার পরদিন সাভার থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ খান অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ ছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অথরাইজড অফিসার হেলাল উদ্দিন ইমারত নির্মাণ আইনে ১৩ জনকে আসামি করে আরও একটি মামলা করেন।

সর্বশেষ খবর