বুধবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব বেলাল চৌধুরী

রবিউল হুসাইন

বাংলা ভাষার খ্যাতিমান কবি বেলাল চৌধুরী আর নেই। আমরা একজন অভিভাবককে হারালাম। তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ সাহিত্যপুরুষ। একজন কিংবদন্তি মানুষ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর চমৎকার ব্যবহারের জন্যও তিনি স্মরণীয় থাকবেন। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনি অনন্য। সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই শ্রেষ্ঠ হয় না, বেলাল চৌধুরী শ্রেষ্ঠ মানুষ। কারণ তিনি কবি, সৎ সম্পাদক, দেশপ্রেমী ও ভালো মানুষ ছিলেন। বহুদিন ধরে তাঁর সঙ্গে আমি মিশেছি। কোনো দিন কারও সঙ্গে তিনি অপ্রীতিকর আচরণ করেননি। ছোট-বড় সবার কাছে তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। কারও মধ্যে কোনো প্রতিভা দেখলে কাছে টেনে নিতেন। বেলাল চৌধুরীর নিজস্ব লেখকসত্তা ছিল। নিজস্ব শৈলীতেই তিনি লিখতেন। কথা বলার ভঙ্গিতে লিখতেন। অত্যন্ত সাবলীল, ভনিতাহীন, সহজ বোধগম্য ছিল তাঁর কবিতা। কথা বলার মতো গদ্য ছন্দে তিনি লিখতেন। এই রীতি তিনিই পরিচিত করেছেন বাংলা সাহিত্যে। তাঁর ব্যক্তিজীবন বৈচিত্র্যময়। এক সময় ঘর পালিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে তাবত সাহিত্যকর্মীদের সঙ্গে তিনি নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। ভীষণ আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা যখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তখন বেলাল চৌধুরী এর সম্পাদনার ভার নিয়েছিলেন। তখন কলকাতা ও বাংলাদেশের সাহিত্যকর্মীদের মধ্যে সেতুবন্ধনকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন বেলাল চৌধুরী। ঢাকায় ফিরে তিনি ভারতীয় দূতাবাস থেকে প্রকাশিত ‘ভারত বিচিত্রা’র সম্পাদক হয়েছিলেন। এ দায়িত্ব পালনকালে বহু তরুণ লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক তৈরির পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল। কেউ ভালো কিছু লিখলেই তিনি প্রশংসা করতেন। উৎসাহিত করতেন। পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। প্রশংসার কার্পণ্য তাঁর ছিল না। তিনি অসম্ভব পরোপকারী মানুষ ছিলেন। কবিতা যেমন নিজে লিখেছেন, তেমনি লেখার ক্ষেত্রও তৈরি করেছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদের অন্যতম সংগঠক ছিলেন বেলাল চৌধুরী। একবার তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্তকে ঢাকায় এনেছিলেন জাতীয় কবিতা উৎসবে। পয়লা বৈশাখ, পৌষমেলা, নবান্ন উৎসবের পাশাপাশি জাতীয় কবিতা উৎসবকে অসাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার  পেছনে তাঁর অসীম অবদান। এখানে একজন রিকশাওয়ালা কবিও কবিতা পাঠ করতে পারেন। জাতীয় সংকটকালেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। সাহসী ভূমিকা তিনি রেখেছেন। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও রফিক আজাদের নেতৃত্বে ‘পদাবলী’ নামে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠের যে সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল চৌধুরী। তিনিই পদাবলী নামটি দিয়েছিলেন। বেলাল চৌধুরী বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। এক অনন্য আলোকিত মানুষ। কবি ও সম্পাদক হিসেবে বাংলাভাষী পাঠকের কাছে তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল। তাঁর গদ্য লেখার হাত ছিল চমৎকার। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’ অত্যন্ত পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, পত্রিকা প্রকাশনা থাকবে, কবিতা লেখা হবে ততদিন গভীর শ্রদ্ধায় বেলাল চৌধুরীর নাম উচ্চারিত হবে। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়। এই মুহূর্তে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। লেখক : কবি ও স্থপতি।

সর্বশেষ খবর