শিরোনাম
শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

‘ডিজিটাল কোকেন’-এ সর্বনাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

‘ডিজিটাল কোকেন’-এ সর্বনাশ

গত বুধবারের ঘটনা। রাজধানীর শেওড়াপাড়ার একটি ভবনের ছাদে ফেসবুকে ব্যস্ত ছিল ১৫ বছরের এক কিশোর। সে কথাও বলছিল কানে হেডফোন দিয়ে। ছাদের ওপর সে অবিরাম হাঁটলেও চোখ ছিল মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। এক পর্যায়ে সে ছাদ থেকেই পড়ে যায় নিচে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে।

এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়া সাইফুল ইন্টারমিডিয়েটেই ফেল। রেজাল্ট দেখে হতবাক তার বাবা মা। কী করে সম্ভব! অবশেষে তারা জানতে পারলেন তাদের ছেলে লেখাপড়ার চেয়ে ফেসবুকেই ব্যস্ত থাকত বেশি। ঘর আটকেও ফেসবুকে চ্যাট করত। বাবা মার ধারণা ছিল তাদের সন্তান লেখাপড়ায় মগ্ন। বাসার সবাই হয়তো একটা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন, শুধু সাইফুল আলাদা। সে ফোনে ফেসবুক নিয়েই থাকতে ভালো বাসত।

ছাদ থেকে পড়ে মারা যাওয়া কিশোর আর ফেল করা সাইফুল-দুজনই নেশায় আসক্ত। তবে এই নেশা সেই নেশা নয়। ফেসবুকের নেশা। মনোবিজ্ঞানীরা এই  নেশাকে ‘ডিজিটাল কোকেন’ নাম দিয়েছেন। আর এই ডিজিটাল কোকেনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন সব ধরনের মানুষ। কোনো কোনো পরিবারের প্রতিটি সদস্যই এই নেশায় আসক্ত।

এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সীমাহীন ফেসবুক ফিড নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে মস্তিষ্কে যে অনুভূতি হয়,  কোকেন ঠিক একই ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে। ফেসবুকে আসক্তরা যেন মাদকাসক্ত। ফেসবুকে অবস্থানের সময় এমনভাবেই কাজ করেন তারা। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক প্রফেসর অফটির টুরেল বলেন, যারা ফেসবুকে না প্রবেশ করে থাকতে পারেন না তাদের মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার অংশে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে। কোকেন নিলে মস্তিষ্কের ঠিক একই অংশে প্রায় একই ধরনের কর্মকাণ্ড চলে। এই  নেশা গাড়ির এক্সেলেটরের মতো কাজ করে। অর্থাৎ গতি বাড়তেই থাকে।

যৌন হয়রানি, অর্থ চুরি, সম্মানহানি ইত্যাদি বহু ঘটনার  পেছনেও রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। অনেকেই এসব কারণে আত্মহত্যার মতো ঘটনারও শিকার হচ্ছে। যেমনটি নেশার কারণে মানুষের মনের ভিতর এমন তৈরি হয়।

মোবাইল ফোন এখন অনেকেরই দৈনন্দিন জীবনধারার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, গড়ে একজন মানুষ এখন প্রতি সাড়ে ছয় মিনিট পর পর একবার করে স্মার্টফোন দেখে নেয়। কিন্তু এটি মানসিকভাবে সন্তুষ্ট করে না। ফলে অসন্তুষ্টি বাড়তেই থাকে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অনেকেই মনে করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে তিনি একজন দক্ষ মাল্টিটাস্কার হয়ে উঠবেন। একই সঙ্গে কাজ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সামলাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একাধিক কাজের দক্ষতা কমে যায়। মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ায় স্মৃতিশক্তিও কমে যায়। ফলে দৈনন্দিন কাজেও দক্ষতা হ্রাস পায়। অনেকেই অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কারণে ভৌতিক কল সিনড্রোম নামে একটি জটিলতায় আক্রান্ত হন। এতে মোবাইলে কোনো কল না আসলেও মনে হতে পারে কল এসেছে। এর কারণ হিসেবে জানা যায় অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে মস্তিষ্কের ভিতরে হেলুসিনেশন বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী অনেকেই বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রাস্তায় চলাচলের সময় দুর্ঘটনার শিকার হন।

গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুকে ছবি দেখে তারা এত দ্রুত বিক্ষিপ্ত হন যে, রাস্তায় চলাচলের সময় সঠিক বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পারেন না। কাজেই বিষয়টি এক অর্থে ভয়ঙ্কর। কারণ রাস্তায় চলাচলের সময় নির্দেশক চিহ্ন না দেখে মোবাইলে ফেসবুকের নোটিফিকেশন দেখতে থাকলে তা দুর্ঘটনা বয়ে আনে।

এ কারণে মানসিক উদ্বেগ বৃদ্ধিসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন বহু মানুষ। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যবহারকারীদের স্মার্টফোন বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য পাওয়া গেছে। অনেকেই একে খুবই বিরক্তিকর এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রতিবন্ধক বলে জানিয়েছেন।

অনলাইনে কটূক্তি ও হেনস্তার শিকার হওয়া অত্যন্ত সাধারণ বিষয়, যার বড় শিকার শিশু-কিশোর। এক জরিপে দেখা গেছে ৭৯ শতাংশ মানুষই অনলাইনে এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। অল্পবয়সে অনলাইনে হেনস্তার শিকার হলে পরবর্তী জীবনে এর বড় প্রভাব পড়ে।

মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নামে ‘সামাজিক’ হলেও বাস্তবে মানুষকে অসামাজিক করে তোলে। এতে মানুষ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বার্থপর হয়ে উঠছে। একজন মানুষ যখন অন্যজনের সঙ্গে কথা বলে তখন ৩০ থেকে ৪০ ভাগ সময় নিজের বিষয়ে কথা বলে বাকি সময় অন্যদের কথা শোনে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে সে ৮০ ভাগ সময় ব্যয় করে নিজেকে নিয়ে।

বাস্তব মানুষ আর অনলাইনের মানুষ এক নয়। যে মানুষকে অনলাইনে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও ব্যতিক্রমী মনে হয় বাস্তবে সে তার বিপরীতটাও হতে পারে। এ কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচিত অনেককেই বাস্তব জগতে এসে স্বপ্নভঙ্গের শিকার হতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিকটিমোলজি অ্যান্ড রেসটোরেটিভ জাস্টিস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহারের কারণে শারীরিকের চেয়ে মানসিক ক্ষতি বেশি হচ্ছে। মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার ব্যবহারের জন্য চোখ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি মেরুদণ্ডেও ব্যথা হতে পারে। হতে পারে ঘুমের সমস্যাও। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মূল যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো ‘বিহেভিয়ার এডিকশন’ অর্থাৎ ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি। আসক্তি যখন হয়ে যায়, তখন সে চাইলেই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। তার কারণে দীর্ঘসময় ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে সাধারণত টিনএজারদের বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ কমে গেছে। তার আচরণ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তার সামাজিক যোগাযোগে পরিবর্তন হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রত্যেকটা জিনিসের একটা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে। এই সোশ্যাল মিডিয়া মানুষ যে উদ্দেশ্যে ব্যবহার শুরু করেছিল এখন অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কখনই বলি না যে এগুলো ব্যবহার করা যাবে না। তবে ব্যবহারের একটা লিমিট আছে। সেটা মেনে চলতে হবে। সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় থাকবে। যাতে তার মধ্যে আসক্তি তৈরি না হয়। এটাই পরামর্শ।

তিনি বলেন, এমন সমস্যায় এখন ক্লাস সেভেন থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সব ধরনের মানুষ। সন্তানদের মধ্যে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, তারা তো আর বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। বেশি যারা আসে তাদের বয়স ২০ বছরের মধ্যে। বড়দের ক্ষেত্রে রিলেশনে সমস্যা হতে পারে। পারিবারিক সমস্যা হতে পারে। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতা সবারই দরকার। কিন্তু আমরা যারা বাবা-মা আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। যখন কোনো সমস্যা হচ্ছে তখন আমরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। একটা বাচ্চা যে কীভাবে বড় হচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, কীভাবে বড় হওয়া উচিত এই জায়গাগুলোতে ছোটবেলা থেকেই মনোযোগ দিতে হবে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর চাইলেও অনেক কিছু হয় না। কারণ যে বাবা-মা আপনাকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অভ্যস্ত করছেন, তিনি কিন্তু আপনার লিমিট ঠিক করে দিচ্ছেন না। এই জায়গায় প্রথম থেকেই বাবা-মাকে সতর্ক হতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারে খুব বেশি বাড়াবাড়ি হওয়া উচিত নয়। এটা বাবা-মাকে বুঝতে হবে।

সর্বশেষ খবর