রবিবার, ৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

রেজাল্ট আত্মহত্যা

মির্জা মেহেদী তমাল

রেজাল্ট আত্মহত্যা

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করতে না পেরে  ফেনীর সোনাগাজী ও ফুলগাজী, গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর এবং পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে ৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে সোনাগাজী ও ফুলগাজীতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে তাহমিনা আক্তার ও সাওদিয়া সাবরিন জেসি নামের দুই শিক্ষার্থী। একই কারণে সাদুল্যাপুরের দুই গ্রামে গলায় ফাঁস দিয়ে শামীম হোসেন মণ্ডল ও বিষপান করে আত্মহত্যা করে সুমনা আক্তার নামে আরও দুই শিক্ষার্থী। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির কাউখালীতে দাখিল পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহত্যা করে পরী আক্তার নামে আরেক শিক্ষার্থী। এসব ঘটনা গত বছরের। একই বছর রাজধানীর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কে ২০ নম্বর বাড়ির কয়েক তলা বেসরকারি একটি কমলজের হোস্টেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ওই  হোস্টেলে গত দুই বছর ধরে অবস্থান করে পড়ালেখা করত পাবনার মেয়ে শেফা আলম। গত এপ্রিল অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় সে। ১৬ এপ্রিল ছিল তার জীববিজ্ঞান পরীক্ষা। শেফা ওই দিনও পরীক্ষায় অংশ নেয়। কিন্তু বিকালে হোস্টেল থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের সঙ্গে আলামত হিসেবে পুলিশ উদ্ধার করে শেফা আলমের আত্মহত্যার একটি চিরকুট। তাতে লেখা ছিল ‘আব্বু, আমি জীবনযুদ্ধে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি, আমার লাশ কফিনে করে বাড়ি নিয়ে যেও। আমি তোমার কাছে প্রমিজ করেছিলাম এ প্লাস পাব, আমি পারিনি। আমাকে মাফ করে দিও।’

পরিবারের সম্মান রক্ষা করতে না পারার গ্লানি আর চাপ সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় এই শিক্ষার্থীরা।

রাজধানীতেই জিপিএ ৫ না পেয়ে ফল প্রকাশের দিনই রাজধানীতে নিখোঁজ হয় এক এসএসসি পরীক্ষার্থী। পরে  রেল লাইনের পাশে পাওয়া যায় তার লাশ। এখানেও আত্মহত্যার কারণ পরিবারের সম্মান রক্ষা করতে না পারার চাপ আর গ্লানি। কারণ ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের পক্ষ থেকে তীব্র চাপ ছিল জিপিএ ৫ পেতেই হবে তাকে। এ ছাত্রের মা তার নাম পরিচয় গোপন রেখে একটি ভিডিও বার্তায় তুলে ধরেন সন্তানের আত্মহত্যার কারণ। ভিডিও বার্তায় তিনি তুলে ধরেছেন কীভাবে দিনের পর দিন ভালো রেজাল্টের জন্য তারা তাদের সন্তানের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।  শেষ পর্যন্ত ভালো রেজাল্ট এবং পরিবারের সম্মান রক্ষা করতে না পারার চাপ ও মনোকষ্টে সন্তান পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয় ফল প্রকাশের দিন। সংশ্লিষ্টরা জানান, অতীতে পড়ালেখা নিয়ে এত উদ্বেগ, এত অস্থিরতা ছিল না শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। পড়ালেখা নিয়ে ছিল না অভিভাবকদের মধ্যে আজকের মতো এত তীব্র এবং উৎকট প্রতিযোগিতা। পরীক্ষায় সন্তানের ভালো ফল হলে তা ভালো লাগে সব মা-বাবারই। কিন্তু এখন অনেক মা-বাবা সন্তানের ভালো ফল নিয়ে সামাজিক প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। তাতে এ অভিযোগ উঠতে শুরু কমরছে যে, অনেক মা-বাবা সন্তানকে ব্যবহার করছেন তাদের সামাজিক সম্মান রক্ষার জন্য। সন্তানের পরীক্ষার ফল এখন অনেক মা-বাবার জন্য প্রেসটিজ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সে জন্য ছোট ছোট সন্তান নিয়ে অনেক মা-বাবা তীব্র প্রতিযোগিতায়  নেমেছেন। যেন পরীক্ষাটা সন্তানের নয়, মা-বাবার। অনেক অভিভাবক কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই স্বীকার করেছেন সন্তান জিপিএ ৫ না পেলে সমাজে তাদের মানসম্মান থাকবে না। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিত, সচ্ছল মা-বাবার ক্ষেত্রে এ ধরনের মানসিকতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। তাদের অনেকে বলেছেন, যে করেই হোক জিপিএ ৫ পেতেই হবে তাদের সন্তানকে। সে জন্য যা যা করা দরকার, যত টাকা খরচ করা দরকার, যত কোচিং প্রাইভেট দরকার তারা করবেন। অভিভাবকদের অতি প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের কারণেই  বোর্ড পরীক্ষায় পাস না করলে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে শিক্ষার্থী বলে মনে করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে ফল খারাপ করা পরীক্ষার্থীর সঙ্গে বিরূপ আচরণ না করার পরামর্শ তাদের। পাশাপাশি সচেতনতা  তৈরিতে সব স্কুলেই একজন করে এডুকেশনাল সাইকোলোজিস্ট বা শিক্ষা বিষয়ক মনোবিদ নিয়োগের তাগিদও দিচ্ছেন তারা। বিশেষজ্ঞ ও মনোবিদরা মনে করছেন, পরিবারের দুর্ব্যবহার, মানসিক দুর্বলতা এবং অনেক বেশি হতাশাগ্রস্ত হওয়ার কারণেই শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যামুখী হওয়ার বড় কারণ হলো— পরিবারের অসহযোগিতামূলক আচরণ। পরিবারের তরফ থেকে সান্ত্বনা না দিয়ে বকাঝকা করার কারণে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তা ছাড়া বর্তমানে সমাজে সামাজিক সাপোর্ট সিস্টেমগুলো না থাকাও এর অন্যতম একটি কারণ। ঢাকা যাত্রাবাড়ীর একটি স্কুল থেকে গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দীপু। সে ৪.৯৫ পয়েন্ট পেয়ে উত্তীর্ণও হয়। তবুও ফল প্রকাশের পর থেকেই তার মন খারাপ ছিল, কান্নাকাটিও করছিল। কারণ দীপুর টার্গেট ছিল সে জিপিএ ৫ পাবে। তাই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে না পারায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে দীপু। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, টিভি চ্যানেলে ও পত্রিকা পড়েই শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ চিনছে। তারা শিখেছে, গত বছর পরীক্ষায় ফেল করে আরেকজন কীভাবে আত্মহত্যা করেছে। তাই এমন সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সবদিক নজর রাখা উচিত বলে মনে করছেন তিনি। তিনি বলেন,  যেসব পরীক্ষার্থী ফেল কিংবা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি তাদের বকাঝকা না করে পরিবারের উচিত তাদের বুঝানো, সান্ত্বনা দেওয়া। অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন,  ছেলেমেয়েদের ভালো ফলাফলের চেয়ে ভালো মানুষ হতে উৎসাহ দিতে হবে। ভালো ফলাফল না করেও নিজেকে মেলে ধরা যায়। কিন্তু ভালো মানুষ না হতে পারলে জীবনটাই বৃথা। আপনার শিক্ষার্থীকে বুঝতে চেষ্টা করুন। ভালো ফলের চেয়ে ভালো মানুষ হতে উৎসাহিত করুন। তাদেরকে সহযোগিতা করুন তাদের মতো বাঁচতে। দেখবেন তারা ঠিকই আপনার স্বপ্ন পূরণ করবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দফতরের তথ্য মতে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ এবং প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করছেন। যাদের একটি বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। ছাত্রী, গৃহবধূ ও কম শিক্ষিত নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আত্মহত্যা ‘মহাপাপ’ এ অমোঘ সত্য কথাটি কম বেশি সবারই জানা। এ সত্য প্রবাদটি জানার পরও মানুষ আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অভিভাবকদের বকাঝকা, পরীক্ষায় ফেল করা কিংবা আশানুরূপ ফল না হওয়া কিশোরীদের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর