বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফোনে শুরু নৃশংসতায় শেষ

মির্জা মেহেদী তমাল

ফোনে শুরু নৃশংসতায় শেষ

প্রেম-পরকীয়ায় জড়িয়ে খুনের ঘটনা বাড়ছে। স্বামীর হাতে স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের শিকার হচ্ছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরকীয়ার বলি হচ্ছেন তৃতীয় কেউ। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক বন্ধনে চিড় ধরা, অস্থিরতা ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব্ব-টানাপোড়েনে আপনজনকে খুনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে হতাশা, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। লাভলী ইয়াসমিন লীনা।

বয়স ২৯। বিবাহিতা। আট ও পাঁচ বছর বয়সী দুই সন্তানের জননী। চলার পথে একদিন চোখ পড়ে এক যুবকের চোখে। নাম তানভীর আহমেদ। বয়স ১৭ বছর পাঁচ মাস। একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। লীনা ও তানভীরের বসবাস একই এলাকায়। তাই চলার পথে মাঝে মাঝে চলে চোখাচোখি। এরপর মোবাইল নম্বর আদান-প্রদান। শুরু হয় আলাপ। আলাপ থেকে প্রেম। যা পরে শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়। স্বামী-সংসার ত্যাগ করে লীনা তানভীরের সঙ্গে নতুন করে ঘর বাঁধতে চায়। একপর্যায়ে লীনা তার স্বামীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চায়। তানভীরকে নিয়ে স্বামী খুনের পরিকল্পনা সাজায়। তানভীরকে এ কাজে সহায়তায় এগিয়ে আসে তার দুই বন্ধু। পরিকল্পনামতো এক রাতে লীনার সহায়তায় তারা হত্যা করে স্বামী গিয়াসউদ্দিনকে। এভাবেই স্ত্রীর পরকীয়া ঘটনায় মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকের নিজ বাসায় খুন হন ঝুট ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন (৩৬)। সম্প্রতি রংপুরে আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিকের পরকীয়ার জেরে। স্নিগ্ধা তার সহকর্মী কামরুলের প্রেমে পড়েন। আর সেটা যখন গাঢ় রূপ নেয় তাতেই বাধে বিপত্তি। স্ত্রীর ‘অবৈধ’ সম্পর্ক কিছুতেই মানতে পারছিলেন না রথীশ। স্বামীর বাধা পেয়ে প্রেমিককে নিয়ে দুই মাস ধরে খুনের পরিকল্পনা করেন স্নিগ্ধা। একপর্যায়ে এই আইনজীবী স্বামীকে দুধের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে হত্যা করেন। রথীশচন্দ্র ও স্নিগ্ধার দীর্ঘ সংসার জীবনে অনার্স পড়ুয়া এক ছেলে ও নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়ে রয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে কুদরত আলী নামে এক ঘটককে গলা কেটে হত্যা করেন তার স্ত্রী মাসুমা খাতুন। দীর্ঘদিনের সংসারে কোনো অভাব-অনটন ছিল না। জানা গেছে, দুজনের মাঝে বোঝাপড়ার অনেক অভাব ছিল। কিন্তু কখনো সমাধানের পথে হাঁটতে চাননি মাসুমা। বরং পাশের এলাকার আরিফ নামের এক যুবকের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন। দিন দিন সে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। স্ত্রীর পরকীয়ার বিষয়টি লোকমারফত জানতে পারেন কুদরত। এ নিয়ে একাধিকবার সতর্ক করেন তিনি। এমনকি প্রেমিক আরিফকেও নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাতেও কাজ হয় না। বরং হিংস্র হয়ে ওঠেন মাসুমা। এরপর স্বামীকে গলা কেটে হত্যা করে পালিয়ে যান তিনি। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সাভারের জামসিং সোলায়মান মার্কেট এলাকায় সিদ্দিক মিয়ার বাড়িতে দিনমজুর স্বামী মোহাম্মদ হোসেন আলী ঘুমন্ত স্ত্রী মারুফাকে গলা কেটে হত্যা করেন। এ ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। জানা গেছে, মোহাম্মদ হোসেন আলী এক নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। বিষয়টি নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ হতো। কিন্তু মারুফার প্রতিদিনের ঝগড়া যেন বিষের মতো হয়ে উঠেছিল হোসেন আলীর কাছে। একপর্যায়ে পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলতে গিয়ে স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যা করেন হোসেন আলী। গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রবাসী স্বামীকে হত্যা করে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন স্ত্রী। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার পুটিমারা গ্রামে ঘটে এ ঘটনা। সকালে থানায় ঢুকেই পুলিশকে বলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে খুন করেছি। আপনারা আমাকে গ্রেফতার করুন।’ মধ্যবয়সী এই নারীর কথা শুনে চমকে ওঠেন থানার পুলিশ সদস্যরা। আটক করা হয় তাকে। তার কথা অনুসারেই বসতঘরের বারান্দা থেকে উদ্ধার করা হয় স্বামী অলিউল্লাহর লাশ। পুলিশসূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সৌদি আরবে চাকরি করছেন অলিউল্লাহ। প্রবাসের আয় দিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী মাজেদা বেগমের নামে অর্ধ কোটি টাকা মূল্যের জমি কিনেছেন তিনি। তিন মাস আগে দেশে ফেরার পর মাজেদার সন্দেহ হয় তার স্বামী সৌদি আরবে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এ সন্দেহ থেকেই কলহের সৃষ্টি। শেষ পর্যন্ত ঘুমন্ত স্বামীকে শ্বাস রুদ্ধ করে হত্যা করেন মাজেদা। এ হত্যার পেছনেও ছিল তার পরকীয়া। পরকীয়ার কারণে এমন হত্যাকাণ্ড দিন দিন বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারিবারিক বন্ধন জোরদার করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ানোর পাশাপাশি চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে। সমাজে বিজ্ঞজন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা ও গণমাধ্যমও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন তারা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, পরকীয়ার কারণে খুন বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বহুগামিতা, ভালোবাসার বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়া, ধর্মীয় মূল্যবোধ না থাকা। আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর ওপর বেশি জোর দিতে হবে। আর সেই সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধন অটুট রাখতে হবে। স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে প্রচুর সময় দিতে হবে। একই সঙ্গে সন্তানদের প্রতিও তাদের যত্নবান হতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর