শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
বজ্রপাতে কেন এত মৃত্যু

১১ দিনেই মারা গেলেন ১১১ জন

মাহবুব মমতাজী

বজ্রপাতে গত ১১ দিনেই মারা গেছে ১১১ জন। গতকালও মৃত্য হয়েছে ৫ জনের। বজ্রপাত এখন দেশবাসীর কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বোরো মৌসুমের ধান ঘরে তোলা নিয়ে আতঙ্কে আছেন সারা দেশের কৃষক। একদিকে শ্রমিক সংকট অন্যদিকে বজ পাত আতঙ্কে ব্যাহত হচ্ছে তাদের ধান কাটার কাজ। দিশাহারা কৃষক ও জমির মালিকরা। বাড়ছে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা। সাম্প্রতিককালে দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বজ পাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কৃষক ছাড়াও আতঙ্কিত শ্রমিক, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সবার মনে প্রশ্ন— বজ পাতে এত মৃত্যু কেন? কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। বন্যা এবং সাইক্লোনের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বজ পাতের বিষয়টি ভূমিকম্পের মতোই আকস্মিক। কিন্তু তারপরও মেঘের আনাগোনা দেখে বজ পাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে খানিকটা ধারণা করা যেতে পারে বলে উল্লেখও করেন তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ পাত ভূমিকম্পের মতোই আকস্মিক দুর্যোগ হলেও কিছু সাবধানতা অবলম্বনের মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ মোকাবিলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও পূর্বাভাস ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। এ ছাড়া বজ পাতজনিত ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে বন উজাড় রোধ, বায়ুদূষণ হ্রাস, বাসাবাড়িতে বজ -নিরোধক দণ্ড ব্যবহারসহ সরকারকে দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শও দেন তারা। ভুক্তভোগী কৃষক ও ধান কাটার শ্রমিকরা বলছেন, প্রতিদিন বৃষ্টি হয় এবং সে সময় বজ পাত হয় বলে কোনো শ্রমিককে এখন কাজে পাওয়া যায় না। ঘন কালো মেঘ। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় কিউমুলোনিম্বাস বা বজ মেঘ। ঝড়ো বাতাসের প্রভাবে দ্রুতগতির কালো মেঘের মধ্যে ঘর্ষণ ও সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হওয়া ইলেক্ট্রনের প্রবাহকে বলে বজ পাত। যা বাতাসের জলীয় বাষ্পের মাধ্যমে নেমে আসে ভূমিতে। জানা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে দেশে বজ পাতে মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ১৬১ জন। ২০১৬ সালে মে মাস পর্যন্ত ৩২ জেলায় মারা গেছেন ১০৩ জন। গত বছর বজ পাতে অন্তত ৮০ জনের মৃত্যু হয়। চলতি বছরে এ সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে।  জানা গেছে, ৩০ এপ্রিল থেকে শুরু করে গত ১০ দিনে সারা দেশে মৃত্যু হয়েছে ১০৬ জনের বেশি। শুধু বুধবারই ১৫ জেলায় মারা গেছে ২৭ জন। সুনামগঞ্জে ১০ দিনে বজ পাতে মারা গেছে ১৭ জন। আহত হয়েছে অন্তত ১৫ জন। ৯০ শতাংশ ধান কাটার কথা বলা হলেও সেই ধান গোলায় তুলতে পারেনি এ এলাকার কৃষক। হবিগঞ্জে বজ পাতে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং অন্তত ৭ জন আহত হয়েছে। রাজশাহীতে মাঠে ধান কাটতে গিয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয় আরও দুজন। নীলফামারীর জলঢাকায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। মানিকগঞ্জে দুজনের মৃত্যু ও ৯ স্কুল শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধান কাটার সময় দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। বজ পাতে কুমিল্লার মুরাদনগরে দুই কিশোরের মৃত্যু হয়। নরসিংদীর মনোহরদীতে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। সিলেট, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর ও গাইবান্ধায় অন্তত ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই বজ পাত নিয়ে চলতি বছর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম এ ফারুকের নেতৃত্বে একটি গবেষণা সম্পন্ন হয়। তিনি ওই গবেষণায় ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ আট বছরের তথ্য সংগ্রহ করেন। এই আট বছরে বজ পাতে নিহতের সংখ্যা ১৮০০’র বেশি দেখানো হয়। উল্লেখ করা হয়, বেশি বজ পাত হয় সুনামগঞ্জ এবং শ্রীমঙ্গলে। কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে বজ পাতও বেড়ে যাবে বলে পূর্বাভাস অব্যাহত রেখেছে আবহাওয়া অধিদফতর। বায়ুমণ্ডলের দূষণ বেড়ে যাওয়াসহ মানব সৃষ্ট কারণেই বজ পাত বেশি হচ্ছে বলেও মত সংস্থাটির। আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, আগামী সাত দিন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিজলি চমকানো এবং বজ সহ বৃষ্টির প্রবণতা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত হ্রাস পেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ পাতের সময় আশপাশে যদি কোনো উঁচু গাছ থাকে সেখান থেকে দূরে থাকা। টিনের ছাদ এড়িয়ে চলা। উপরে ছাদ আছে এমন জায়গায় অবস্থান নেওয়া। বিদ্যুতের খুঁটি ও টাওয়ার থেকে দূরে থাকাও নিরাপদ। বজ্রপাতে পাঁচ প্রাণহানি : কুমিল্লার মেঘনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নওগাঁয় বজ পাতে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা ও গতকাল বজ পাতের এ ঘটনা ঘটে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর— দাউদকান্দি : কুমিল্লার মেঘনায় পৃথক স্থানে বাজ পড়ে বুধবার রাতে দুজন মারা গেছেন। নিহতরা হলেন— মেঘনা উপজেলার উমরাকান্দা গ্রামের সুরুজ মিয়ার মেয়ে জাহানারা (২৮) ও স্থানীয় বালুরচরে আনোয়ার হোসেন নামে এক শ্রমিক। এছাড়া বজ পাতে মারা গেছে হরিপুর গ্রামের কৃষক আবদুল মতিনের তিনটি গরু।  ব্রাহ্মণবাড়িয়া : বিজয়নগরে বজ পাতে পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান সাইফুল ইসলাম (৩৫) নিহত হয়েছেন। এ সময় গুরুতর আহত হন আজাদ মিয়া (৩৪) নামে আরেক লাইনম্যান। উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের বড়পুকুরপাড়ে বুধবার সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত সাইফুলের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। আজাদকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার গোড়াদিঘা গ্রামে বজ পাতে মারা গেছেন মোমেনা খাতুন (৫০) নামে এক নারী কৃষি শ্রমিক। তিনি গোড়াদিঘা গ্রামের কালু মিয়ার মেয়ে। স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে বাড়ির সামনে ধান মাড়াইয়ের কাজ করছিলেন মোমেনা। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে বজ পাতে তার মৃত্যু হয়। নওগাঁ : পত্নীতলা উপজেলার হরিপুর গ্রামের মাঠে ধান কাটতে গিয়ে বজ পাতে ফিরোজ হোসেন (৩০) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানায়, কয়কেজন শ্রমিকের সঙ্গে মাঠে ধান কাটছিলেন ফিরোজ। এ সময় বজ পাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।

সর্বশেষ খবর