শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

কী হবে আজ ছাত্রলীগের সম্মেলনে

রফিকুল ইসলাম রনি ও ফরহাদ উদ্দীন

টান টান উত্তেজনা নিয়ে আজ অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশ  ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন। সিলেকশন না ইলেকশন, এ নিয়ে গত কদিন ধরে ছিল আলোচনা। সবকিছু ঠিক থাকলে বিকাল ৩টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবারের সম্মেলনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আবার সংগঠনের শীর্ষ পদ পেতে প্রার্থীরাও মরিয়া। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের কাছে ধরনা দেন বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চান শতভাগ ক্লিন ইমেজের একটি কমিটি। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুগত এবং কোনো ধরনের বদনাম নেই, যোগ্য ও মেধাবীদের কমিটিতে স্থান দেওয়ার পক্ষে তিনি। ফলে গত এক মাস ধরেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। শীর্ষ পদের প্রার্থীদের দিয়ে প্রথমে সমঝোতা করার চেষ্টা করা হবে, না হয় স্বচ্ছ ব্যালটে ভোট।

কাউন্সিলরদের ভোটে, না সমঝোতায় হবে নতুন কমিটি- সে বিষয়টি গতকাল পর্যন্ত স্পষ্ট হয়নি। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন কমিটি গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে বলেছিলেন, যেভাবে হওয়ার সেভাবেই হবে। ইতিমধ্যে কে কে প্রার্থী তাদের তালিকা নেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি আছে। তালিকায় আসা আগ্রহীদের ডেকে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। সমঝোতা হলে এই কমিটির প্রেস রিলিজ দেওয়া হবে। তা না হলে ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হবে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর প্রাধান্য পেয়ে এলেও এবার এর বাইরে থেকে শীর্ষ পদে কেউ আসতে পারেন বলে আলোচনা রয়েছে। ২০০২ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের ছিলেন। ওই কমিটির সভাপতি লিয়াকত শিকদার ঢাকা কলেজের এবং সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।  সূত্রমতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আনতে সংগঠনের পরিশ্রমী, ত্যাগী, যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থী খোঁজা হচ্ছে। প্রার্থীদের ইমেজ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়তা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও অবদান, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ভূমিকা, পারিবারিক রাজনৈতিক মতাদর্শসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। স্কুলজীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত কি-না তাও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কোনোভাবেই কমিটিতে অনুপ্রবেশকারীদের ঠাঁই দেওয়া হবে না। এবারের সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আসা ৫০ হাজার নেতা-কর্মীর বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঝড় বৃষ্টি মাথায় রেখেই মূল মঞ্চসহ সর্ব সাধারণের বসার স্থান ?ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি গেটে নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবী কর্মীও থাকবে। এবার লক্ষাধিক নেতা-কর্মীর সমাগম হবে বলে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে ছাত্রলীগ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি। প্রতি বছরের মতো এবারও সম্মেলনের প্রথম দিনের প্রথম পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন নেতৃত্ব গঠনে কিছু নির্দেশনা দিয়ে যাবেন। সেই নির্দেশনার আলোকে পরবর্তী নেতা নির্বাচিত হবেন। ??একই সঙ্গে সোহাগ-জাকির কমিটির বিলুপ্তি ঘোষণা করা হবে। এবার ছাত্রলীগ নেতাদের বয়সের ক্ষেত্রে তিন ক্যাটাগরিতে ফরম বাছাই করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২৭ বছর, ২৯ বছর এবং ২৯ ঊর্ধ্ব বয়সী। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী যদি ২৭ বছর নির্ধারণ করে দেন তাহলে তার বেশি বয়সীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবেন। একইভাবে যদি ২৯ বছর নির্ধারণ করেন তাহলে তার বেশি বয়সীরা বাদ পড়বেন। সেভাবে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে ফরমগুলো। মূল সম্মেলন শুরু হবে বিকাল সাড়ে ৩টায়। এর আগে বেলা ১২টা থেকে নেতা-কর্মীসহ সর্বসাধারণ সম্মেলনস্থলে প্রবেশ করবেন। সন্ধ্যায় কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। কনসার্টে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম ও নগরবাউল খ্যাত জেমস সংগীত পরিবেশন করবেন।

জমা পড়েছে ৩১৮টি মনোনয়নপত্র : এমন প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে গত ৭ মে। এর আগে গত ২-৫ মে পর্যন্ত মনোনয়নপত্র বিক্রি করা হয়। জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন জমা হওয়া মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আরিফুর রহমান লিমন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানান, এবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে মোট ৩১৮টি। এর মধ্যে কেউ কেউ উভয় পদে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। প্রার্থীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি সদ্য বিলুপ্ত বিভিন্ন ইউনিট কমিটির নেতারাও রয়েছেন। সভাপতি পদের জন্য ১২৫ জন এবং সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য ২০০ জন ফরম তুলেছেন।

সোহাগ-জাকিরের বিদায় : ২০১৫ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই ছাত্রলীগের ২৮তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে দায়িত্ব পান বর্তমান সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন। দায়িত্ব গ্রহণের সাড়ে ৫ মাসের মাথায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন সোহাগ-জাকির। এরপর সারা দেশে ১১০টি সাংগঠনিক শাখার মধ্যে ৮০টি শাখার সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ ছাড়াও ৩৫টি বিদেশ শাখার কমিটি গঠন করেছেন বর্তমান নেতৃত্ব। আজকের সম্মেলনের মাধ্যমে তারা বিদায় নেবেন।   

বয়সসীমা কমছে না : গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২৭ বছরের বেশি বয়সী কেউ ছাত্রলীগের নেতা হতে পারবেন না। তবে ২০০৬ সাল থেকে সর্বশেষ কমিটি পর্যন্ত অলিখিতভাবেই বয়সসীমা ২৯ বছর হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এবারও বয়সসীমা ২৯ রাখা হচ্ছে। 

মঞ্চে চারজন : ছাত্রলীগের সম্মেলনের মূল মঞ্চে বসবেন চারজন। প্রধান অতিথি হিসেবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিশেষ অতিথি হিসেবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ছাত্রলীগ সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন। অন্য অতিথিরা সামনের সারিতে বসবেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেবেন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কাজী এনায়েত, অভ্যর্থনা কমিটির আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ বাপ্পী। সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করবেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন এবং শোক প্রস্তাব পাঠ করবেন দফতর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন শাহজাদা। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী ভাষণের পর ছাত্রলীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক আরিফুর রহমান লিমনের বক্তৃতা দেওয়ার কথা রয়েছে। 

৩ হাজার ৩০০ কাউন্সিলর ও ১৮ হাজার ডেলিগেট : ছাত্রলীগের সম্মেলনে সারা দেশের ৩ হাজার ৩০০ কাউন্সিলর ও ১৮ হাজার ডেলিগেট অংশ গ্রহণ করবেন। ইতিমধ্যে তাদের কার্ড বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দফতর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন শাহজাদা।

আলোচনায় যারা : কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেতৃত্বে আসতে পারেন বলে যাদের নাম আলোচনায় রয়েছে, তারা হলেন কমিটির  সহ-সভাপতি আদিত্য নন্দী, আরেফিন সিদ্দিক সুজন, চৈতালী হালদার চৈতী, সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মো. শওকতুজ্জামান সৈকত, আশিকুল পাঠান সেতু, প্রচার সম্পাদক সাইফ উদ্দিন বাবু, দফতর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন শাহজাদা, ত্রাণ ও দুর্যোগ সম্পাদক ইয়াজ আল রিয়াদ, শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, পাঠাগার সম্পাদক ইলিয়াস সানী, প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম শামীম, উপ-আইন সম্পাদক মো. সাদ্দাম হোসেন, সহ-সম্পাদক মাহফুজ ইবনে রহমান দিপু, খাদিমুল বাশার জয়, এ এফ রহমান হলের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান তুষার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জয়নুল আবেদিন রাসেল। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গত বছরের ২৬ জুলাই কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। সেদিন পর্যন্ত যাদের বয়স ২৯ বছরে রয়েছে তাদের নিয়েও আলোচনা রয়েছে সর্বমহলে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যোগ্য, মেধাবী, বিচক্ষণ, সাহসী ও বিরোধী দলে রাজপথে ছিলেন তাদের মধ্য থেকে এবারের শীর্ষ নেতৃত্ব আসবে বলে জানা গেছে। এসব বিবেচনায় আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার (ঢাবি) সভাপতি আবিদ আল হাসান, কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মেহেদী হাসান রনি ও যুগ্ম-সম্পাদক সায়েম খান।

নিজের জন্য কোনো সময় পাইনি : সোহাগ :  ছাত্রলীগের বিদায়ী সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে কাজ করেছি। একটি দিনও নিজের জন্য ব্যয় করিনি। সংগঠনের কাজে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ছুটে বেড়িয়েছি। নেত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো বাস্তবায়ন করেছি।

শিক্ষার্থীদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি। সারা দেশে সবুজ বনায়ন করতে বৃক্ষরোপণ, সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম করিয়েছি। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে আমরা জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং দেশরত্ন শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কাজ এগিয়ে নিতে ছাত্রলীগকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করেছি। শিক্ষার্থীরা যেন সঠিক ইতিহাস জানতে পারে সেজন্য জাতির জনকের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজ নামচাসহ মুক্তিযুদ্ধের বই বিতরণ করেছি। আমরা সারা দেশে ৮০টি ইউনিটে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব উপহার দিয়েছি। তারপরও বলব দায়িত্ব পালনের কোনো ভুলত্রুটি থাকলে তার জন্য ক্ষমা চাইছি। আর সফলতাগুলো সারা দেশের ছাত্র সমাজের তথা ছাত্রলীগের নিবেদিত কর্মীদের উৎসর্গ করলাম।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছাত্র সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সারা দেশ ঘুরে বেরিয়েছি : জাকির : ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন বলেন, সারা দেশে ছাত্র সমাজের ভোটের মাধ্যমে আমরা দুই ভাই ছাত্রলীগের দায়িত্ব নেই। দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর থেকে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ এবং দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশনা ছড়িয়ে দিতে সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমরা কতটুকু কাজ করেছি, কতটুকু সফল তার বিচার করবেন বাংলার ছাত্র সমাজ ও ছাত্রলীগের নিবেদিত নেতা-কর্মীরা। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি করিনি।

সর্বশেষ খবর