শনিবার, ১২ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইতিহাসের এক টুকরো বাতিঘর ঢাকা কেন্দ্র

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-৩৭

মাহবুব মমতাজী

ইতিহাসের এক টুকরো বাতিঘর ঢাকা কেন্দ্র

উনিশ শতকের শুরুর কথা। ঢাকার বাইশ-পঞ্চায়েতের সরদার পেয়ার বখশ ছিলেন সূত্রাপুর-ফরাশগঞ্জের একজন আলোচিত মঞ্চশিল্পী। তার অভিনীত মঞ্চনাটক দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শক সমাগম ঘটত। পেয়ার বখশ সরদারসহ অনেকেই তখন নিজস্ব অর্থায়নে খোলা চত্বরে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে নাটক করতেন। পুরান ঢাকার সরদারদের আরেক অন্যতম মাওলা বখশ। মদন সাহা লেনে তারই বাড়িতে ঘটত সেই সমাগম। পাশে মোহিনীমদন দাস লেনে ঢাকার ইতিহাস রক্ষায় মাওলা বখশ সরদার ও তার ছেলে আজিম বখশ গড়ে তুলেছেন ‘ঢাকা কেন্দ্র’। আজ এটি ইতিহাসের এক টুকরো বাতিঘর।

জানা যায়, ১৯৮৮ সালে পুরনো দিনের স্মৃতি সংগ্রহে গড়ে ওঠে মাওলা বখশ সরদার ট্রাস্ট। ১৯৮৯ সালে এ ট্রাস্টের অধীনে চালু হয় হাসপাতাল। পরে ১৯৯৭ সালে ঢাকা কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। সূত্রাপুরের কাগজীটোলা হয়ে শ্যামবাজারে প্রবেশমুখে যে কারও চোখে পড়বে মাওলা বখশ সরদার দাতব্য চিকিৎসালয়ের সাইনবোর্ড। সেখানে মরিচ-পিয়াজ আর মসলাপট্টির ঘিঞ্জি রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলেই এক অন্য জগৎ। মধ্যখানে আছে সরদার পরিবারের ব্যবহূত নানা রকম মাটির হাঁড়ি-পাতিল, বিশালাকৃতির টেলিভিশন। টেলিভিশনটি এখন অচল হলেও সেটি দেখার মতো। শেলফের ভিতর আছে ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি হুঁকা, সরদার পরিবারের থালা-বাটি-গ্লাস-পিরিচ। দেয়ালে টাঙানো প্রায় শতবর্ষী তিনটি জাপানি ঘড়ি। আণ্টাঘরের ময়দান বা বাহাদুর শাহ পার্কে যে আণ্টা খেলা হতো, সেই আণ্টা সংগৃহীত আছে এই ঢাকা কেন্দ্রে। সাজানো আছে বন্দুকের কার্তুজ রাখার চামড়ার ব্যাগ, মোরগ-পোলাওয়ের ডিশ। নবাবি ও ব্রিটিশ আমলে ব্যবহূত বিভিন্ন আকারের ইট। সরদার পরিবারের সোনা-রুপার জরি দিয়ে তৈরি জামা-কাপড়, বৈদ্যুতিক রেকর্ড প্লেয়ার, পুরনো টেলিফোন সেট শোভিত করেছে আলমারিটি। বহুকাল আগের বিভিন্ন মডেলের রেডিও দেখলে মুগ্ধ হবে যে-কেউই। বাতিদানি, কলের গানের গ্রামোফোন টেনে নিয়ে যায় পেছনের স্মৃতিতে। পাশের কক্ষেই সাজানো আছে থরে থরে বই। এসব বইয়ে ঢাকার শত শত বছরের পুরনো ইতিহাস। আছে নানা রকম কাগজপত্র ও আলোকচিত্র। রুপার পানদানি ও গোলাপজলদানি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এ স্থানটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সুন্দর এই সংগ্রহশালাটি প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে এবং শুক্রবার খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত—বললেন সংশ্লিষ্টরা। পুরো ভবনটি পুরান ঢাকার বাইশ-পঞ্চায়েতের অন্যতম সরদার মাওলা বখশ সরদারের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশে গড়ে উঠলেও এখানে রয়েছে মুঘল আমলে প্রচলিত নিত্য-প্রচলিত জিনিসপত্র। মাওলা বখশ সরদারের পারিবারিক সহায়তায় পরিচালিত হয় সংগ্রহশালাটি। নিচতলায় চক্ষু হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। দোতলায় বিশাল এলাকাজুড়ে ঢাকা কেন্দ্র। মাঝখানের একটি ঘরে জাদুঘর। এখানে স্থান পাওয়া নানা উপকরণ দর্শনার্থীকে নিয়ে যাবে সেই সুদূর অতীতে। জানা যাবে ঢাকার আদ্যোপান্ত। তবে ঢাকা কেন্দ্র পাঠাগারটি এ প্রতিষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র। এ পাঠাগারে ঢাকাবিষয়ক বইয়ের প্রাধান্যই বেশি। প্রায় ৪০০ বই রয়েছে ঢাকাবিষয়ক। এর মধ্যে প্রায় সবই দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য। এখানেই সংগ্রহ করা আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষার্থী লীলাবতী নাগের নানা তথ্য-উপাত্ত। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর আসামের গোয়ালপাড়া শহরে। ছাত্রী থাকা অবস্থায়ই তিনি নারীশিক্ষা, নারীর ভোটদান প্রভৃতি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৩ সালে ঢাকায় দীপালি সংঘ নামে একটি নারী সংগঠনের জন্ম দেন তিনি। কথা হয় ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আজিম বখশের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ঢাকা কেন্দ্রে পুরনো দিনের বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ ছাড়াও তারা সবুজায়নে গুরুত্ব দেন। ঢাকা কেন্দ্র ভবনের ছাদে গড়ে ওঠা বাগানে ঔষধি গাছগাছড়া আছে পাঁচ-ছয় প্রজাতির। তবে এখানে দুর্লভ ক্যাকটাসের সংখ্যা বেশি। ক্যাকটাস আছে ২৫-২৬ প্রজাতির।

সর্বশেষ খবর