রবিবার, ১৩ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

মানবিকতার ফাঁদ

মির্জা মেহেদী তমাল

মানবিকতার ফাঁদ

দুপুরের ঘামঝরা রোদে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন এক পুরুষ। বেশ মোটা। তার মাথায় একটা হাঁড়ি। বয়স্ক একজন লোককে এমনভাবে কাঁদতে দেখে তার সামনে লোকজনের ভিড় হয়। সবাই জানতে চায়, তিনি কাঁদছেন কেন। কিন্তু লোকটি যেন কথাই বলতে পারছেন না। তার অনবরত কান্না চোখের পানি দেখে অনেকের মন নরম হয়ে যায়। বারবার জিজ্ঞাস করার পর লোকটি জানান, তিনি মাছের ফেরিওয়ালা। ঘুরে ঘুরে মাছ বিক্রি করেন। সেদিন দুপুরের আগেই তার সব মাছ বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু বাসায় যখন ফিরছিলেন, কাঁটাবন মোড়ে পড়েন ছিনতাইকারীর কবলে। তার টাকা-পয়সা যা ছিল সব লুটে নিয়েছে। এখন লোকটি নিঃস্ব। বাসায় তার পরিবার অপেক্ষায়। তিনি ফিরবেন। ফেরার পথে বাজার সদাই করে নিয়ে যাবেন। কিন্তু ছিনতাইকারীরা তার সারাদিনের মাছ বিক্রির টাকা নিয়ে চম্পট। শাহবাগ বাস স্ট্যান্ডে এসব কথা বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। বাসায় পরিবারের জন্যে কীভাবে খাবার নিয়ে যাবেন তিনি। এসব শুনে লোকজন মানবিক কারণে নিজেদের পকেট থেকে টাকা বের করতে থাকে। কেউ ৫০ কেউ ১০০ করে টাকা সেই লোকটিকে দিতে থাকেন। এ সময় হঠাৎ একজন চিৎকার করে উঠলেন। বললেন, ভাইয়েরা থামুন। এই লোক গতকাল বাংলামোটরে একই গল্প করেছেন। আমি নিজেও ৫০ টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু আজও তিনি যখন একই গল্প বলছিলেন, বুঝে নিতে সমস্যা হচ্ছে না যে, তিনি একজন প্রতারক। আরেক ঘটনা কদিন আগের। ‘ভাইয়া একটা কথা বলা যাবে’— বলতে বলতে কাছে এসে পথ আগলে দাঁড়ায় এক তরুণী। তার মাথায় একটা ছোট প্লাস্টার লাগানো। চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা। চেহারায় বিষণ্নতা। তরুণী বলেন, ‘আমি ইডেন কলেজের ছাত্রী। আমি আর আমার মা ঢাকায় আসার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি। আমি অল্প আঘাত পেয়েছি। মা এখন ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। আমার ভাইয়া বরিশাল মেডিকেল কলেজের ডাক্তার। সেখান থেকে আসছেন। এখন রাস্তায়। কিন্তু আমি সমস্যায় পড়ে গেছি ভাইয়া।’ কথা শেষ না করেই দীর্ঘশ্বাস টানে তরুণী। এরপর আবারও বলতে থাকে। তার মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে হবে। দুশো টাকা আছে তার কাছে। আরও তিনশ টাকা দরকার। রাজধানীর হাই কোর্ট চত্বর মোড়ে দাঁড়িয়ে এভাবেই কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। ওষুধের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে জানিয়ে প্রথমে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করার কথা বললে তরুণী জানায়, কোনো সমস্যা নেই। সে তার অসুস্থ মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। তবে ওষুধ কিনে যেতে হবে। আগে টাকা চায় তরুণী। ঢাকা মেডিকেলের সামনে ফার্মেসি আছে সেখান থেকে ওষুধ কেনা যাবে বলে তরুণীকে সেদিকে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সে সম্মত হয়। হাঁটতে থাকে ধীরে ধীরে। এ সময় তার মায়ের নাম জানতে চাইলে সে জানায়, শরিফা বেগম এবং ডাক্তার ভাইয়ের নাম আহমেদ। তার ভাইয়ের বিস্তারিত পরিচয় জানার চেষ্টা করলে বিরক্ত হয় তরুণী। তার ভাইয়ের ফোন নম্বর চাইলে ক্ষেপে যায়। জানায়, অবিশ্বাসীর কোনো সহযোগিতা তার প্রয়োজন নেই। বারবার অনুরোধ করলেও দ্রুত শহীদ মিনার এলাকা দিয়ে একটা রিকশা ডেকে চলে যায় ওই তরুণী। তাত্ক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেলে ছুটে গিয়ে জরুরি বিভাগে শরিফা বেগম নামে ওই রোগীর খোঁজ করে তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। রাজধানীতে এরকম ঘটনা ঘটছে অহরহ। বিপদগ্রস্ত হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করলেও তারা মূলত এক শ্রেণির প্রতারক। অনেক সময় তাদের ধোঁকায় পড়ে আর্থিক সহযোগিতা করেন সহজ সরল মানুষ। একইভাবে ফার্মগেট এলাকায় মাঝে মধ্যে বোরকা পরা চল্লিশোর্ধ্ব বছর বয়সী এক নারী ও তার দুই শিশু সন্তানকে দেখা যায়। তাদের সঙ্গে থাকে একটি ব্যাগ। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরপরই তারা এই কাজে রাস্তায় নামেন। ফার্মগেট মোড়ে সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ দেখলেই টার্গেট করে এগিয়ে যান। অসহায়ের মতো পথ আগলে দাঁড়িয়ে নিজের সমস্যার কথা বলেন। প্রতিবার একই সমস্যার কথা জানান এই নারী। ওই নারীর কথানুসারে, তার বাড়ি ভোলায়। বড় ছেলেটা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ঢাকায়। শুনেছেন মিরপুরে একটি গার্মেন্টে চাকরি করে। কিন্তু খুঁজে পাননি। ছেলের কোনো মোবাইল ফোনও নেই। হাতে যা টাকা ছিল তা খরচ হয়ে গেছে। এখন রাত হয়ে যাচ্ছে। কোথায় থাকবেন, কী খাবেন বুঝতে পারছেন না। প্রায় আট বছর বয়সী ছেলেকে দেখিয়ে বলেন, দেখেন বাবাজি ছেলেটা ক্ষুধার জ্বালায় ক্যামন হয়ে গেছে। আমাদের একটু সাহায্য করেন। আমরা বাড়িতে চলে যাব। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই নারীর নাম সুলতানা। থাকেন রাজধানীর কল্যাণপুরের বস্তিতে। স্বামী আকলাছ একজন রিকশাচালক। দুই সন্তান নিয়ে প্রায় এক বছর ধরে ওই বস্তিতে আছেন তিনি। প্রতিবেশীরা জানান, প্রায়ই বিকালে বোরকা পরে দুই সন্তানকে নিয়ে বস্তি থেকে বের হয়ে যান। ফিরেন রাত ১০টার দিকে। এ বিষয়ে ওই নারীর মুখোমুখি হলে তিনি স্বীকার করে জানান, পেটের দায়ে এরকম প্রতারণা করেন তিনি। একেকদিন একেক স্থানে অবস্থান নিয়ে সহযোগিতার নামে প্রতারণা করেন তিনি। এটাকে অপরাধ মনে করেন না এই নারী।

একইভাবে দীর্ঘদিন থেকে গাবতলী, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ও সদরঘাটে অভিন্ন প্রতারণা করে যাচ্ছে বেশ কয়েক নারী। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন এতে প্রকৃত বিপদগ্রস্তরা সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, এটি একটি অপরাধ। নৈতিক শিক্ষার অভাবেই এ ধরনের প্রতারণা করা হচ্ছে। এতে করে সহযোগিতাকারীদের অবিশ্বাস সৃষ্টি হবে। ফলে প্রকৃত বিপদগ্রস্তরা সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এ জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রকৃত বিপদগ্রস্তদের চিনে সহযোগিতা করতে হবে বলে জানান তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর