ফলমূল, দুধ, মাছে বিষ। অন্যান্য খাদ্যপণ্যও ভেজালমুক্ত রাখা যায়নি। এমনকি জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি ‘পানি’ পর্যন্ত নিরাপদ থাকছে না। যত্রতত্র নকল কারখানা বানিয়ে পুকুর-ডোবা এবং ওয়াসার পানি বিশুদ্ধকরণ ছাড়াই বোতলজাত করে ‘বিশুদ্ধ মিনারেল পানি’ বলে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্লাস্টিক জারে ভরা পানি বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে পৌঁছানোর মাধ্যমেও জমে উঠেছে দূষিত পানির রমরমা ব্যবসা। সেসব বোতল-জারের পানি জীবন রক্ষার পরিবর্তে নানা অসুখ-বিসুখের সৃষ্টি করছে। কিন্তু জীবন রক্ষাকারী পানি নিয়ে ‘মরণঘাতী খেলা’ চালানো নকল কারখানাগুলো বন্ধে বিএসটিআইর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না থাকার অভিযোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে নকল ও ভেজাল কারখানার মালিক ধরা পড়লেও জরিমানা দিয়ে আবার অবৈধ পানি কারখানা পরিচালনায় লিপ্ত হন তারা।
অনুমোদন ছাড়াই ভেজাল ও নকল কারখানায় অবাধে তৈরি হচ্ছে ‘বিশুদ্ধ’ নামের ড্রিংকিং ওয়াটার। বোতল ও জারে ভর্তি করে এসব ভেজাল ও নিম্নমানের দূষিত পানি সরবরাহ করা হচ্ছে হোটেল, দোকান, অফিস-আদালতে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার একাধিক সিন্ডিকেট এই দূষিত পানি বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এ পানি পান করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। দীর্ঘদিন একনাগাড়ে পান করায় অনেকেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিএসটিআইর তথ্যমতে, রাজধানীতে প্রতিদিন নানা ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি বিক্রি হয় প্রায় পাঁচ কোটি লিটার। জারজাত মিনারেল ওয়াটার বিক্রি হয় ১৫ কোটি লিটার। জারজাত পানির বেশির ভাগই নকল। রাজধানীর কয়েক কোটি মানুষ এ পানির ক্রেতা। নকল জেনেও মানুষ যেমন এসব পানি কিনেই খাচ্ছে। জেনেশুনেও কেউ বাধা দেওয়ার সাহস করছে না। দিনের পর দিন চলছে এসব কারখানা। রাজধানীর কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, ডেমরা, ওয়ারী, ধানমন্ডি, কলাবাগান, সবুজবাগ, খিলগাঁও, কোতোয়ালি, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, বাড্ডা থানা এলাকায় খোঁজ নিয়ে কয়েকশ নকল পানির কারখানার তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী থানা এলাকায় রয়েছে শতাধিক কারখানা। নামি কোম্পানির ভুয়া সিল লাগিয়ে বিক্রি হচ্ছে মিনারেল ওয়াটারের বোতল। নিউটাউনের হাতিয়াড়ায় হানা দিয়ে এমনই এক ভুয়া মিনারেল ওয়াটার তৈরির কারখানায় হদিস পেয়েছে এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই নকল মিনারেল ওয়াটার। দেখতে হুবুহু ব্র্যান্ডেড কোম্পানির মিনারেল ওয়াটারের বোতল। কিন্তু পুরোটাই নকল।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সূত্র জানায়, বাজারে সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হওয়া সাতটি কোম্পানির বোতলজাত পানি পরীক্ষা করেও দেখা গেছে, সেসবের কোনোটাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত নমুনার সঙ্গেও এসব বোতলজাত পানির সামঞ্জস্য রাখা হয়নি। প্রয়োজনীয় লেড, ক্যাডমিয়াম ও জিঙ্ক উপাদানের অস্তিত্ব মেলেনি। এ পানিতে আয়রন, পিএইচ, ক্লোরিন, ক্যালসিয়াম-ম্যাগনেশিয়ামও আছে নামকাওয়াস্তে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের পরীক্ষাগারে বোতলজাত পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ‘অতি নিম্নমানের পানি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিএসটিআইর কর্মকর্তারা দেশের সর্বত্র নিম্নমানের পানি বাজারজাত হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, বেশির ভাগ পানি কোম্পানি নকল ও ভুয়া। সারা দেশে বর্তমানে ২৮৭টি বৈধ পানি বোতলজাতের কারখানা থাকলেও শুধু রাজধানীতেই পানির জার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। সেসব কারখানায় পানির মান রক্ষার কোনো বালাই নেই। অবৈধ কারখানাগুলো নিয়ন্ত্রণেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ওয়াসার উপমহাপরিচালক ড. ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই ওয়াসার সরবরাহ লাইনের পানি গামছায় ছেঁকে বোতলে ভরে বাণিজ্য করা হচ্ছে।’ বিএসটিআই সূত্র বলেছে, রমজান শুরুর ১৫ দিন আগে থেকেই রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে নকল পানির কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। র্যাবের উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ১০টিরও বেশি পানি কোম্পানির মেশিনপত্র জব্দ করা হয়েছে। জরিমানা ও কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে নকল কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু তবু নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত, অস্বাস্থ্যকর কারখানার বোতলজাত পানির ব্যাপক বেচাকেনা বন্ধ হচ্ছে না।শরবত-জুস থেকেও সাবধান : প্রচণ্ড গরমে তেষ্টা মেটাতে নগরীর ব্যস্ততম রাস্তায়, ফুটপাথে বা অলিগলির মোড়ে ‘আখের রস’ আর হরেক রকমের ‘শরবত’ বিক্রির দৃশ্য চোখে পড়ে। ঘৃতকুমারীর পাতা, ইসবগুলের ভুসি, ফলের টুকরা-রসসহ বাহারি সব পানীয় নানা রকম জীবাণু সংক্রমিত করছে। বেশির ভাগ শরবতই তৈরি হচ্ছে দূষিত পানি দিয়ে। মাছবাজারের ব্যবহৃত বরফের সাহায্যে তৈরি হচ্ছে আখের রস। জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল্লাহ জানান, ফুটপাথের শরবতে হেপাটাইটিস-ই ও হেপাটাইটিস-এ রোগ সংক্রমণের প্রবণতা রয়েছে। ব্যবহৃত রং কিডনি ও লিভারেও জটিলতা সৃষ্টি করে। রেক্টিফায়েড স্পিরিট ব্যবহার করে দেদার তৈরি হচ্ছে এনার্জি ড্রিঙ্কস ও ফিলিংস জুস। এর আগে র্যাবের অভিযানে গাজীপুর, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর এলাকায় ১০টিরও বেশি নকল জুস কোম্পানি সিলগালা করা হয়েছে। বিএসটিআইতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এনার্জি ড্রিঙ্ক বলতে কোনো পণ্যসামগ্রী উৎপাদন বা বাজারজাতের জন্য বিএসটিআই কোনো অনুমোদন দেয় না। তা সত্ত্বেও অনুমোদন পাওয়ার জন্য একটি আবেদনপত্র বিএসটিআই কার্যালয়ে জমা দিয়েই কারখানায় দেদার উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
ভেজাল নয়, পুরোটাই নকল দুধ : পানির সঙ্গে সয়াবিন তেল আর বিষাক্ত রাসায়নিক পারঅক্সাইড মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘গরুর দুধ’। তৈরি করা সে গরুর দুধে খাঁটি দুধের স্বাদ আনতে ব্যবহার করা হয় ওয়ে পামিএইট পাউডার নামে বিশেষ ধরনের একটি দ্রব্য। এভাবে উৎপাদিত ‘গরুর দুধ’ শুধু হাট-বাজারে নয়, সরবরাহ করা হতো দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনকারী নামিদামি অনেক প্রতিষ্ঠানেও। ইতিমধ্যে ডিবি পুলিশের অভিযানে এমন নকল দুুধ কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। একই স্টাইলে রাজধানীতে আরও বেশ কয়েকটি নকল দুধ কারখানার অস্তিত্ব থাকার অভিযোগ রয়েছে। সংঘবদ্ধ চক্রটি শুধু ভেজাল দিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা পুরোপুরি নকল দুধ তৈরি করছে। এই দুধ সংগ্রহে কোনো গাভীর প্রয়োজন পড়ে না, কষ্ট করে গড়ে তুলতে হয় না গবাদিপশুর খামার। ছানার পানির সঙ্গে কেমিক্যাল মিশিয়ে সহজেই তৈরি করা হচ্ছে এমন ‘বিষ’! পরে ‘খাঁটি দুধ’ হিসেবে তা চালান হয়ে আসছে রাজধানীতে। দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে এতে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। আবার পানি গরম করে তাতে অ্যারারুট মিশিয়ে এবং কয়েক পদের রাসায়নিক পাউডারের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে দুধের সর্বনাশ তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি নকল দুধ পানে পেটের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর প্রভাব পড়তে পারে কিডনি বা লিভারের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও। নকল দুধ তৈরির কারখানাগুলোতে ছানার ফেলনা পানি, খাওয়ার পানি, খাইসোডা, অল্প পরিমাণে পারঅক্সাইড, ময়দা, ভাতের মাড় ও চিনি মিশিয়ে আগুনে ফোটানো হয় এবং পরে কাটিং অয়েল ও এসেন্স মিশিয়ে দুধের সুবাস সৃষ্টি করা হয়। ধলেশ্বরী ঘাট থেকে নকল দুধের চালান পাঠানো হয় দুটি নামিদামি ডেইরি প্রজেক্টে। পরে ওই প্রজেক্টের প্লাস্টিক মোড়কে প্যাকেটজাত দুধ হিসেবে তা বাজারে বাজারে পৌঁছে যায়। রাসায়নিক মিশ্রিত এসব নকল দুধ পানের কারণে মানবদেহে ডায়রিয়া, জটিল পেটের পীড়া, কিডনি ও লিভার রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। বেশি ঝুঁকি রয়েছে শিশুদের ক্ষেত্রে।
সমন্বয়হীনতায় মিলছে না ‘ভেজাল মুক্তি’ : খাদ্যপণ্যে ভেজাল বন্ধের মূল দায়িত্বে আছেন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)। এ ছাড়া ঢাকা সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগেরও বড় একটি ভূমিকা থাকার কথা। সংস্থাগুলোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদফতর, জেলা প্রশাসন, র্যাব, পুলিশসহ ছয় মন্ত্রণালয়ের ১০টি বিভাগের প্রতি ভেজাল রোধকল্পে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় বলতে কিছুই নেই। এর আগে ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনকারী একজন ম্যাজিস্ট্রেট জানান, যৌথ পরিকল্পনা ছাড়াই মাঝেমধ্যে একেকটি সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে অভিযান চালিয়ে থাকে। এতে ভেজাল রোধে খুব একটা সফলতা আসছে না। তিনি বলেন, পারস্পরিক সমন্বয় ও পরিকল্পনা নিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে না। বারবার ধরা পড়া চিহ্নি?ত ভেজালকারীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে অভিযানের নামে লাখ লাখ টাকা জরিমানা আদায় হয় বটে, তবে ‘ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য’ কেনাবেচা নিশ্চিত হয় না মোটেও। এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেই ভেজাল নির্মূল যাবে না। কারণ সারা দেশে প্রতিদিন অভিযান চালানো যেমন সম্ভব নয়, তেমনি দিন-রাত এ কার্যক্রম মনিটর করাও সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, বাজার কমিটি, পেশাজীবীসহ সর্বসাধারণের উদ্যোগ আর সচেতনতাতেই ভেজালের বিষ থেকে স্থায়ী মুক্তি দিতে পারে।