সোমবার, ২১ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
কেমন বাজেট চাই

সব রপ্তানি খাতে সমান সুবিধা দিন

————— মো. জসিম উদ্দিন

রুহুল আমিন রাসেল

সব রপ্তানি খাতে সমান সুবিধা দিন

আসছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে রপ্তানিমুখী সব শিল্প খাতে সমান সুবিধা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক প্রথম সহসভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। তার মতে, বাজেটে রাজস্ব আয়ের টার্গেট বেশি হলে, ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়বে। তিনি শিল্পায়ন ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইর সাবেক এই প্রথম সহসভাপতি বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান। নিজ প্রতিষ্ঠানের গুলশান কার্যালয়ে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মো. জসিম উদ্দিন বলেন, রপ্তানির কিছু খাত ভালো করছে। কিছু খাত বহুমুখীকরণ দরকার। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে— কোনো একটি রপ্তানিমুখী খাতে বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে, এই সুযোগ অন্যরা পায় না। যেমন— তৈরি পোশাকশিল্পকে ১২ শতাংশ আয়কর দিতে হয়। কিন্তু প্লাস্টিকসহ অন্যান্য খাত থেকে ৩৫ শতাংশ আয়কর নেওয়া হয়। আমি মনে করি— যেহেতু ৮০ শতাংশ পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়। বাকি ২০ শতাংশ অন্যান্য পণ্য সামগ্রী রপ্তানি হয়, তাই এসব পণ্য রপ্তানিতে আরও বেশি সুবিধা দেওয়া উচিত। এই খাত ২০ শতাংশ নীতি সহায়তা পেলে রপ্তানি আরও বাড়বে। আমার বিশ্বাস সরকার এটা চায়, কিন্তু আমলাদের গাফিলতির কারণে হচ্ছে না। ফলে দেখা যায়— একটি সুবিধা কেউ পাচ্ছেন, কেউ নিতে পারছেন না। এক্ষেত্রে সব প্রকার রপ্তানিখাতকে একই ভাবে সমান সুবিধা দেওয়া উচিত। এতে রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণ আরও ভালো হবে। নতুন নতুন খাতগুলো ভালো করবে। এবারের বাজেটে এসব সমস্যার সমাধান আসা উচিত।

তিনি বলেন, এবারের বাজেটে ক্রিটিকাল দিক হলো— রাজস্ব আয়ের টার্গেট বেশি হলে, ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বেশি হবে। তাতে ভ্যাট ও কর নিয়ে চাপ আসবে। আরেকটি হলো— নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিবেশটা ভালো হতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবেশ খারাপ হলে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও নির্বাচনের বছরে সরকার কিছু সুবিধা দিতে চাইবে। যারা কর দেয় না, তাদেরও ধরা উচিত।

বিনিয়োগ সম্পর্কে মো. জসিম উদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকায় নির্বাচন মাথায় রেখেই এবারের বাজেট হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে মাথায় রাখতে হবে— আমাদের শিল্পখাতের উন্নয়ন ছাড়া বিকল্প নেই। সুতরাং প্রতিবছর যে লাখ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় শিল্পায়ন। তাই শিল্পায়ন সহায়ক অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দিতে হবে বাজেটে। মিরেরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অনেক বিদেশি কোম্পানি জমি নিয়েছে। এগুলো যখন পুরোপুরি হবে— তখন বিদেশিরা আরও এগিয়ে আসবেন। বিদেশিরা জমি কিনে, তা উন্নত করে বিনিয়োগ করতে চায় না। অঞ্চলগুলোতে জমি যদি দ্রুত তৈরি করা যায়, তাহলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ দুটোই দ্রুত আসবে।

বেঙ্গল গ্রুপের এই ভাইস-চেয়ারম্যান বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা— এসডিজি ও বাংলাদেশের লক্ষ্য ২০২১ সালে মধ্যআয়ের এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এই লক্ষ্য মাথায় রেখে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট করতে হবে এবং শিল্পায়নকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিল্পায়নের জন্য কিছুটা রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। কিন্তু প্রতিবছর বাজেটে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মোট রাজস্ব প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হলে, কর্মকর্তাদের ওপর চাপ পড়ে। সেই চাপ সর্বশেষ পড়ে সাধারণ করদাতা, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও শিল্প মালিকদের ওপর। কারণ, আমরা যারা নিয়মিত কর দিচ্ছি, তাদেরই বার বার ধরা হচ্ছে। কিন্তু যারা করজালের বাইরে আছেন, তাদের ধারে-কাছেও যাচ্ছে না কর প্রশাসন। নতুন করদাতাদের কাছে না যেতে পারলে, নিয়মিত যারা কর দিয়ে যাচ্ছেন, তাদেরই ওপর চাপ পড়বে। একজন ব্যবসায়ীর ব্যবসা বাড়ল, নাকি কমল, তা রাজস্ব কর্মকর্তারা দেখেন না, তারা বলেন— গত বছর যেহেতু ১০০ টাকা কর বা ভ্যাট দেওয়া হয়েছে, এবার ১৩০ টাকা দিতে হবে। এভাবে চাপ দিয়ে রাজস্ব আদায়ের ফলে ছোট ও মাঝারি শিল্প বা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে প্রভাব পড়ে। বাজেট এই সমস্যার প্রতিকার চাই।

মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রচুর তহবিল খরচ করছে। এখানে সমস্যা হচ্ছে— আমাদের যে সব দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন, তা তৈরি হচ্ছে না। বাংলাদেশে শিল্পায়ন যা-ই হচ্ছে, এখন কিন্তু শুধুমাত্র শ্রমিকই নয়, আমাদের কারিগরি ম্যানেজার দরকার। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে এখন বেশি কাজ করা প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ যত এগিয়ে যাবে, ততই এই সংকট বাড়বে। ইতিমধ্যে দক্ষ মানবসম্পদের সংকট শুরু হয়ে গেছে। আমাদের সামান্য কিছু বিদেশি লোকজন কাজ করে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের ৭০ লাখ শ্রমিক বিদেশ থেকে দেশে আনছে মাত্র ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সংকট উত্তোরণে বাজেটে উচ্চ পর্যায়ের দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে।

প্লাস্টিকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্লাস্টিকদ্রব্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিপিজিএমইএর এই সভাপতির দাবি— দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় প্লাস্টিকশিল্পের আমদানি হওয়া যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও উপকরণের শুল্ক, মূসক, সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি দিতে হবে। প্লাস্টিক শিল্পের কাঁচামালের আমদানি শুল্ক কমাতে হবে। ওষুধ শিল্প, কৃষি ও খাদ্যের মোড়ক হিসেবে ব্যবহৃত মধ্যবর্তী পণ্যের কাঁচামালের আমদানি শুল্ক কমাতে হবে। তার মতে, তৈরি প্লাস্টিক পণ্য আমদানি পর্যায়ে অধিক হারে শুল্ক আরোপ করতে হবে। কারণ, দেশে অনেক প্লাস্টিকশিল্প রয়েছে। তারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করছে।

এফবিসিসিআইর সাবেক এই প্রথম সহসভাপতি বলেন, এখন গ্যাস দেওয়া শুরু হয়েছে। তরল জাতীয় গ্যাস— এলএনজিও দ্রুত পাওয়া যাবে। তবে এলএনজির দাম কমাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। ভর্তুকি না পেলে শিল্পখাত সক্ষমতা হারাবে। এলএনজি দিয়ে সরকার ব্যবসা করবে, এমন ধারণা রাখা ঠিক হবে না। এলএনজি দিয়ে ব্যবসা করা হলে, গ্যাসভিত্তিক অনেক শিল্পখাত টিকতে পারবে না। গ্যাসের দাম বাড়লে টেক্সটাইল মিলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীরা ভর্তুকি সুবিধা পেলে দেশ মধ্যআয়ের পথে এগিয়ে যাবে।

মো. জসিম উদ্দিন মনে করেন স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা খুবই দরকার। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিওর সঙ্গে চুক্তির কথা বলে সম্পূরক শুল্ককর তুলে দেওয়ার এক ধরনের মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের শিল্প সুরক্ষার জন্য উল্টো শুল্কারোপ করছে। আমাদেরও স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে এন্টিডাম্পিং ও কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপ করতে হবে। এটা করতে না পারলে দক্ষতা তৈরি হবে না। এসব বিষয় অনুধাবনের মতো সক্ষমতা আমাদের বাণিজ্য সংগঠন সমূহ, কিংবা ট্যারিফ কমিশনসহ সরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহেরও নেই।

সর্বশেষ খবর