বুধবার, ২৩ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

শান্তিরক্ষীরাই সন্ত্রাসীদের মূল টার্গেট

শিমুল মাহমুদ, মালি থেকে

আফ্রিকার মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তিরক্ষীরাই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। ফলে বিশ্বশান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের গত ৩০ বছরের যাবতীয় অর্জনের ধারাবাহিকতা শেষে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত হয়ে নিজেদের নিরাপত্তার দিকেই জোর দিতে হচ্ছে বেশি। সংগ্রহ করতে হচ্ছে অত্যাধুনিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও যোগাযোগ উপকরণ। মালির রাজধানী বামাকো থেকে ১২০০ কিলোমিটার দূরে গাওয়ে এসে সেই  নিরাপত্তা আয়োজনই চোখে পড়ল ব্যাপকভাবে। বাংলাদেশ থেকে নয় গুণ বড় মালির বিশাল উত্তরাঞ্চলজুড়ে সাব-সাহারা মরুভূমি। সোমবার বিকালে সেই মরু প্রদেশ গাওয়ে এসে জীবনের চরম অভিজ্ঞতাটি হলো। রাজধানী বামাকো থেকে আড়াই ঘণ্টার বিমানযাত্রা শেষে যখন গাও এয়ারপোর্টে নামলাম, তখন বাতাসে আগুনের হলকা বইছিল। চামড়া পুড়ে যাচ্ছিল। তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাঝে মাঝে ৫০ ডিগ্রির ওপরে উঠে যায়। কখনো ওঠে তীব্র ধূলিঝড়। এয়ারপোর্টের কাছেই একসঙ্গে অনেক দেশের শান্তিরক্ষা মিশনের ব্যাটালিয়ন। প্রতিটি দেশের ক্যাম্প ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী। বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নে পৌঁছার সময় দেখা গেল গেটে পাহারারত আফ্রিকার একটি দেশের শান্তিরক্ষীরা মাথায় জলপট্টি দিয়ে ডিউটি করছেন। ধূলিঝড় থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সৈনিকরাও একটি করে স্কার্ফ সঙ্গে রাখেন। আমরা রুমে ঢুকে ফ্রেশ হওয়ার আগেই হঠাৎ সিকিউরিটি সিগন্যাল বেজে ওঠে। সবাই হুড়মুড় করে দৌড়ে শেল্টারে আশ্রয় নেন। সঙ্গে দৌড় দিই আমরাও। কর্মকর্তারা বললেন, আমাদের সিগন্যাল কোনো কিছু ডিটেক্ট করতে পারলেই অ্যালার্ম দেয়। অবশ্য এটা ছিল মহড়া। উল্লেখ্য, মালির সরকারি বাহিনী, বড় সুবিধাভোগী ফ্রান্সের বারখান, পাশের দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত সশস্ত্র গ্রুপ জি-৫ এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর ক্রমাগত তৎপরতা সত্ত্বেও মালির উত্তরাঞ্চলে সংঘাত বেড়েই চলেছে। শান্তিরক্ষীরা তাদের অন্যতম টার্গেট হলেও বাদ যাচ্ছে না সাধারণ মানুষসহ কোনো পক্ষই। আক্রান্ত না হলে শান্তিরক্ষীরা অস্ত্র ব্যবহার করে না এই বিশ্বাসে তারা সহজ টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন। এমন কোনো সপ্তাহ নেই যে, এভাবে লোকজন নিহত হচ্ছে না। তিম্বকতু রিজিওনাল ইউএন বেইজ গত বছরের শেষে এক মাসে চারবার রকেট আক্রমণের শিকার হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরাও অত্যাধুনিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও যোগাযোগ উপকরণ ব্যবহার করছেন। সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে মাইন রেজিস্ট্যান্স আর্মার প্রটেকটেড ভেহিকল (এমআরএপিভি)। তার মানে, এই গাড়ির নিচে যদি মাইন পড়ে সেটা সে প্রোটেক্ট করবে এবং চারদিকে ১০০ মিটার পর্যন্ত জ্যামার তৈরি করতে পারে। যার মাধ্যমে রিমোট কন্ট্রোলে যদি কেউ মাইন বিস্ফোরণ ঘটাতে চায় তাহলে সেটা ব্যর্থ হবে। এই গাড়ির চাকার বিশেষত্ব হলো, এর চাকা যদি কোনো হামলায় পাংচার হয়ে যায় তাহলেও এটি ২০-৩০ কিলোমিটার অনায়াসে পেরিয়ে যেতে পারবে। ওপরে যে সৈন্য থাকে সে না থাকলেও এটি ভিতর থেকে অপারেট করা যায়। এটি একেবারে মডার্ন ভেহিকল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে। বিশ্বের এক নম্বর ঝুঁকিপূর্ণ শান্তিরক্ষা মিশন মালিতে সার্বিক ঝুঁকি বিবেচনায় এ যানটি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া সেন্ট্রাল আফ্রিকা ও মালিতে আমাদের শান্তিরক্ষীরা শত শত যানবাহন ও সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন। যার ভাড়া বাবদ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে বাংলাদেশ। কোনো কোনো সরঞ্জামের ভাড়ার আয়ে কেনা দাম উঠে গেছে অনেক আগেই। স্থানীয় কনটিনজেন্ট কমান্ডাররা বলেছেন, শান্তিরক্ষা মিশনের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী যখন যা চেয়েছে বর্তমান সরকার তার সবই দিয়েছে। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা মিশনে জাতিসংঘের নির্ভরতার জায়গায় পৌঁছে গেছে। মালিতে কর্মরত সেনাবাহিনীর একজন মেজর বলেন, কত কষ্ট করে, জীবনকে তুচ্ছ করে এক বছর মিশন করলাম। এখানকার কষ্টের কথা কাউকে বলিনি। নিজের স্ত্রীকেও নয়। আপনারা এখানে না এলে কি বিশ্বাস করতেন, এখানকার মিশনে কত কষ্ট। তিনি দেশে ফিরছেন আগামী সপ্তাহে। সেন্ট্রাল আফ্রিকায় বাংলাদেশের কান্ট্রি সিনিয়র কর্নেল খন্দকার আলী রেজা বলেন, বাংলাদেশ অত্যন্ত গরিব একটা দেশ, এখন ধনী হচ্ছি। আমরা এখন দেশ থেকে অনেক সাপোর্ট পাচ্ছি। সরঞ্জামের দিক থেকে অনেক সহায়তা পাচ্ছি। ভালো ভালো সরঞ্জাম দিয়ে আমাদের সুরক্ষিত করা হচ্ছে। ফলে আমাদের প্রফেশনালিজমটা ডিসপ্লে করতে পারছি। এজন্য দেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

সর্বশেষ খবর