সোমবার, ২৮ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

উপহারে সর্বনাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

উপহারে সর্বনাশ

নাইজেরিয়ান খেলোয়াড় হেনরি ইশিকা। বাংলাদেশে ভাড়ায় ফুটবল খেলেন। হঠাৎ তিনি গ্রেফতার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলশানের ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান। নাইজেরিয়ান এই ফুটবলার গ্রেফতার হওয়ায় সাধারণ মানুষ হতবাক। পরে বেরিয়ে আসে তার অপরাধ কর্মকাণ্ডের ভয়ঙ্কর কাহিনী। জাল জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। কয়েক বছর আগেকার ঘটনা এটি। সম্প্রতি তিনি জেল হাজত থেকে বেরিয়ে  আসেন। জড়িয়ে পড়েন আরও অত্যাধুনিক সব অপরাধ কর্মকাণ্ডে। গড়ে তোলেন ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্র। তবে এবার অপরাধের ধরন পরিবর্তন করেছেন। সহজ-সরল নারীদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে ফাঁদে ফেলেন। তারপর বিভিন্ন কৌশলে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। সম্প্রতি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর হাতে আটক হেনরি ইশিকা ও তার সহযোগী ইসমাইল হোসেন আটকের পর বের হয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, নাইজেরিয়ান ফুটবলার হেনরি ইশিকা পরিকল্পিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো, ভাইবার, মেসেনজারের আইডি সংগ্রহ করে সহজ-সরল নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। এরপর উপহার বা অনেক সময় চাকরি দেওয়ার নাম করে আদায় করেন অর্থ। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নেওয়ার পর যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ঠিক এমনই এক ভুক্তভোগী কাফরুলের তাহমিনা পারভীন। তিনি একজন স্কুল শিক্ষিকা। পিবিআই জানিয়েছে, তাহমিনার ফেসবুক আইডিতে কিছুদিন আগে উইলিয়াম ডেভিড নামের একজন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। সেই রিকোয়েস্টটি গ্রহণ করেন তাহমিনা। তখন মেসেনজারের মাধ্যমে তাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। একসময় উইলিয়াম ডেভিড তাহমিনার কাছে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর চায়। পরে দুজনের হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে কথাবার্তা চলত। কিছুদিন যাওয়ার পর উইলিয়াম উপহার পাঠানোর জন্য তাহমিনার কাছে তার বাসায় ঠিকানা চায়। পরে তিনি তার বাসার ঠিকানা দেন। কয়েকদিন পর ব্যবহূত মোবাইল নম্বরে বেন কার্লোস নামের এক ব্যক্তি ফোন দিয়ে বলেন তিনি ডেল্টা কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করেন। উইলিয়াম ডেভিড নামের এক ব্যক্তি ইংল্যান্ড থেকে একটি পার্শ্বেল পাঠিয়েছে। সেই পার্শ্বেলটি পাওয়ার জন্য বিমানবন্দরের কাস্টমস অথোরিটি ৪৫ হাজার টাকা দাবি করছেন। টাকা পরিশোধ করলেই সেই পার্শ্বেলটি পাওয়া যাবে। এ জন্য বেন কার্লোস মো. সালাহ উদ্দিনের নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কারওয়ান বাজার ব্রাঞ্চের একটি ব্যাংক হিসাব দেন। পরে তাহমিনা একই ব্যাংকের ডাচ্-বাংলা শাখা থেকে ওই হিসাবে ৪৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। টাকা পেয়ে কার্লোস তখন উপহারটি দিচ্ছি দেব বলে সময় নেন। এর কিছুক্ষণ পরে কার্লোস আবার তাহমিনাকে ফোন করে বলেন, ওই উপহারের প্যাকেটের ভিতরে পাউন্ড আছে যা কাস্টমসের এক সিনিয়র কর্মকর্তার নজরে এসেছে। এ জন্য আরও ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিতে হবে। এত টাকা পাঠানোর জন্য সময় চাইলে কার্লোস তখন মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে বলে ভয়ভীতি দেখান। মামলার ভয়ে তাহমিনা আবার মো. একরাম মুন্সী নামের আরেক ব্যক্তির ডাচ্-বাংলা ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। তখন কার্লোস তাকে তাহমিনাকে জানায় সময়মতো উপহারটি পেয়ে যাবেন। পরের দিন আবার কার্লোস তাকে ফোন করে জানায় উপহারের প্যাকেটের ভিতরে বাংলাদেশি টাকায় ১ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮০ টাকা থাকায় শতকরা ৩ শতাংশ হারে ৩ লাখ ২৩ হাাজার ৩২০ টাকা ট্যাক্স জমা দিতে হবে। ওই সময় তাহমিনা কার্লোসের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি রাজি হননি। তখন তাহমিনার আর বোঝার বাকি থাকে না তিনি ফাঁদে পা দিয়েছেন। পিবিআই আরও জানায়, একই চক্রের প্রতারণার শিকার হন তুরাগ থানা এলাকার নাজিয়া তাবাসসুম ওরফে শাওন। তিনি মাস্টার মাইন্ড নামক একটি স্কুলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করেন। কিছুদিন পর অজ্ঞাত একটি মোবাইল নম্বর থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে এক ব্যক্তি জানায় মাস্টার মাইন্ড স্কুলে চাকরি পেতে হলে ১ লাখ টাকা দিতে হবে। বিভিন্ন কথাবার্তার একপর্যায়ে তাকে একটি ব্যাংক হিসাব নম্বর দেওয়া হয়। পরে তিনি জনতা ব্যাংকের উত্তরা মডেল টাউনের একটি শাখা থেকে ৪০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। টাকা পাঠানোর পর শাওন ওই ব্যক্তির মোবাইল নম্বর বন্ধ পান। অভিযোগ পেয়ে পিবিআই তাদের মোবাইল নম্বর, ফেসবুক আইডি, হোয়াটস অ্যাপ চ্যাটিং পর্যালোচনা করে ২ মার্চ তাদেরকে পূর্ব তেতজুরী বাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। আটক দুজনই পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। তারা এই কাজের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। এই দুই ভুক্তভোগী ছাড়াও আরও অনেকের সঙ্গে এরকম উপহার ও চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, মামলাটি পিবিআইর উপপরিদর্শক মো. জুয়েল মিঞা তদন্ত করেছেন। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত দেশি-বিদেশি আরও কেউ জড়িত আছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাত্কৃত অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর