মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা
বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ

ধরন বদলাচ্ছে প্রকৃতি

জিন্নাতুন নূর

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে সে তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে। ক্লাইমেট ভালনারবিলিটি ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার বিপন্ন দেশগুলোর একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রকৃতি তার ধরন বদলাতে শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এরই মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন, সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি, বজ পাত বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় এলাকায় মাটি এবং নদীর লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার মতো বড় ধরনের পরিবর্তন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকা গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার সাতটি হটস্পট দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দেশে বৃষ্টিপাতের সময় বদলে গিয়েছে। এখন অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। আর বঙ্গোপসাগর ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে ছয়টি ঋতুর মধ্যে এখন মাত্র চারটি ঋতুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। আর বাকি দুটি ঋতু প্রকৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, বঙ্গোপসাগরের উচ্চতা তিন ফুট বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষ তাদের আবাসস্থল হারাবে। বিজ্ঞানীরা ভয় পাচ্ছেন যে, আগামী ২১০০ সালে সাগরের উচ্চতা পাঁচ থেকে ছয় ফুট বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ তাদের আবাসস্থল হারাবে। পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ‘হেমন্ত’ ও ‘বসন্ত’ এই দুটি ঋতু প্রকৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। আবহাওয়া অধিদফতর থেকে ঘন ঘন ৩ নম্বর বিপদ সংকেত দেওয়া হচ্ছে। দেশে শিলাবৃষ্টি ও ঘন কুয়াশাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আশঙ্কা করছি ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে। ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন অব মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর এক গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের ধরনের পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর এই পরিবর্তন মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ‘এসেসিং দ্য ক্লাইমেট চেঞ্জ, এনভায়রনমেন্টাল ডিগ্রাডেশন অ্যান্ড মাইগ্রেশন নেক্সাস ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক গবেষণায় জানানো হয়, জলবায়ুর পরিবর্তনে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে সাইক্লোন, বজ পাত, জোয়ার-ভাটায় সৃষ্ট বন্যা, লবণাক্ততা, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির মতো সমস্যাগুলো বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। আর দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ, আকস্মিক বন্যা, নদী থেকে সৃষ্ট বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। খুলনা, পটুয়াখালী, রাজশাহী ও সুনামগঞ্জের ৩২০টি বাড়ির ওপর এই গবেষণাটি করা হয়। ভবিষ্যতে এই চারটি জেলার বাসিন্দাদের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে হবে। সাইক্লোন নিয়ে কাজ করে এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যে, বিগত এক দশকে ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মোট ১৩১টি উপকূলীয় সাইক্লোন সৃষ্টি হয়। যার মধ্যে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ৩৩টি সাইক্লোন বয়ে যায়। এক জরিপে বলা হয় বছরে গড়ে ১.১৫ শতাংশ সাইক্লোন বাংলাদেশের ওপর আঘাত করে। দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সম্প্রতি সময়ে সাইক্লোনের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য ভবিষ্যতে উপকূলীয় সাইক্লোন হওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাইক্লোনের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় মাটি ও জলাশয়ে লবণাক্ততার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য বিভিন্ন স্থানে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এবং ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড ফিস বাংলাদেশের ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে করা জরিপ থেকে দেশের উকূলীয় এলাকার নদীগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনেও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে এসব এলাকায় সুপেয় পানির সংকট এবং সুন্দরবনের জলাশয়ের জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ছে। লবণাক্ততার কারণে বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, খুলনা এবং পটুয়াখালীর মানুষের জীবন এরই মধ্যে দুরূহ হয়ে পড়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে খুলনার ৯৮% এবং ভোলার ৯৭ % নদীর পানি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে বুয়েটের রিসার্চ অ্যান্ড একাডেমিক কমিটি অব দ্য ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে প্রতিবছর দেশে ৮.৪৯ মিমি হারে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর বর্ষা মৌসুমের আগে ৫.১২ মিমি হারে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য এমন হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর বাণী : দিবসটির সাফল্য কামনা করে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০১৮ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘আসুন প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করি, প্লাস্টিক পুনঃব্যবহার করি, না পারলে বর্জন করি।’ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দিবসটি উদযাপনে দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠান ও কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। টিআইবি : এদিকে পরিবেশ দূষণ রোধে প্লাস্টিকের বেআইনি উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং ব্যবহার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গতকাল এক বিবৃতিতে পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যবহৃত তহবিলসহ জলবায়ু অর্থায়নে পরিচালিত সব কার্যক্রমে স্বচ্ছতার চর্চা ও জন-অংশগ্রহণ বৃদ্ধির দাবিসহ আট দফা দাবি পেশ করেছে টিআইবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর