মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

বারবার কেন পাহাড়ধস

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

বারবার কেন পাহাড়ধস

রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার— এই পাঁচ জেলায় এবারও বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন ভূপ্রাকৃতিক ও পরিবেশবিদরা। গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন পাহাড় ধসের বিশেষ বিশেষ কারণগুলো। কিন্তু ভূমি ব্যবহারকারীরা এই কারণগুলো উপেক্ষা করায় এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উদাসীনতায় প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে পাহাড় ও পাহাড়ি বনভূমি। বিশেষজ্ঞদের মতে—আমাদের পাহাড়গুলো টারশিয়ারি যুগের, হিমালয়ের সমসাময়িক এই পর্বতগুলো ভাজ শ্রেণির। তবে হিমালয়ের সঙ্গে মূল পার্থক্য হলো এখানকার ভূমির ধরন। কারণ হিমালয়ের বেশিরভাগ পাহাড় পাথুরে, আর এখানকার পাহাড় বেশিরভাগ বেলে মাটি দিয়ে গঠিত। কেন এই পাহাড়ধস? এ বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবান জেলার মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পাহাড়িরা এখানে কয়েকশ বছর ধরে রয়েছে। তারা জানে, কীভাবে পাহাড়ের ক্ষতি না করে কৃষিকাজ করতে হয়, কীভাবে পাহাড়ের ক্ষতি না করে ঘর বানাতে হয়। সমতলের মানুষদের সেই জ্ঞান নেই। তারা সেখানে সমতলের মতো করে ঘর বানাচ্ছে, পাহাড় কেটে সাবাড় করছে। পাহাড় ধসের এটা একটা অন্যতম কারণ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আশির দশকের শুরুতে পার্বত্য এলাকায় ব্যাপকহারে অন্য এলাকা থেকে এনে বাঙালিদের বসতি স্থাপন করা হয়। পাহাড়ি এলাকা কেটেই বসতি নির্মাণ করা হয় তখন। এ ছাড়া গত ১৫ বছরে পার্বত্য এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। বগা লেক, থানচি, আলীকদম, সাজেক, বাঘাইছড়ির মতো দুর্গম এলাকাতেও পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। বেশিরভাগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে পাহাড় কেটে। আবার সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কের পাশের পাহাড় ধসে পড়ে। সড়কের পাশের খাদে সড়ক ধসে পড়ে। কোনো পাহাড়ের চূড়া বা ঢাল যদি একবার কাটা হয় তাহলে ওই পাহাড় বাঁচানো সম্ভব নয়। কাটা চূড়া বেয়ে বৃষ্টির পানি নেমে পাহাড়ের ভিতরটা ধীরে ধীরে নরম হয়ে যায়। এটা যে এক দিনে বা এক মৌসুমে হয়, তা না। বেশ কয়েক বছরে পাহাড়টির মাটি ক্ষয় হতে থাকে। বৃষ্টি হলেই সেগুলো ধসে পড়তে শুরু করে। আর প্রতিবছরই পার্বত্য এলকায় ভূমি ধসে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে—পার্বত্য এলাকায় পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হলেও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। সেতু, বাঁধ, সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে পাহাড়ের ভিত আরও নরম হয়ে যায়। এ ছাড়া ব্যাপকহারে গাছ কাটার ফলে পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন স্থান ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। এদিকে দুর্ঘটনা, প্রাণহানিসহ নানা বিপর্যয় ঘটলেও পাহাড়ে অপরিকল্পিত বসতি তৈরি থেমে নেই। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বাড়তে থাকলেও এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান বা বসতি সংখ্যার তথ্য নেই প্রশাসনের হাতে। এমন অবস্থায় অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে যেনতেনভাবে বসতি গড়ে তুলছে মানুষ। এতে যেমন তারা নিজেরা ঝুঁকিতে পড়ছে, তেমন ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে প্রকৃতিকেও। জানা গেছে, নদী ভাঙনের কবলে পড়ে এবং বৈশ্বিক নানা কারণে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া মানুষ প্রথমেই আশ্রয়ের জন্য বেছে নেন পাহাড়কে। সমতলে বসতি গড়ার চেয়ে পাহাড়ে বসতি গড়া অনেক সহজ হওয়ায় এ বসতি বেড়েছে। কারও কারও মতে, ঝুঁকির মধ্যে বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলেই পাহাড়ে বসতির হার বাড়ছে এবং দুর্ঘটনার মাত্রাও বাড়ছে। পরিবেশবিদদের মতে, প্রশাসন যদি আন্তরিকতা নিয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করে— তবে পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কমবে না, বরং বাড়তেই থাকবে। ইউএনডিপির পরিবেশ বিভাগের ন্যাশনাল কনসালটেন্ট ড. গোলাম মাহাবুব সরওয়ার বলেন, এখনো সমতলের চেয়ে পাহাড়ে সহজেই মানুষ তাদের আশ্রয় খুঁজে পায়। প্রতি বছর নদী ভাঙনের কবলে পড়ে দেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষই ভূমিহীন ও উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে, যাদের একটি অংশ সহজে আশ্রয় খোঁজার জন্য পাহাড়কেই বেছে নেয়। সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. দানেশ মিয়া বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আগে যদিও দুয়েকবার পাহাড় ধস হয়েছে কিন্তু এখন বিপর্যয় আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। কারণ, পাহাড়কে আঘাত করা এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে, পাহাড় এখন উল্টো আঘাত করতে শুরু করেছে। পাহাড়ধস ঠেকাতে প্রাকৃতিক বনকে ফিরিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দেন অধ্যাপক দানেশ। তিনি মনে করেন, টানা ১০ বছর কোনোভাবে বিরক্ত না করলে এই বন ফিরে আসতে পারে। আমরা সবসময় বলতাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে ‘বায়ো ডাইভার্সিটি হটস্পট এরিয়া’। এখানে দীর্ঘ দিনের পুরনো প্রাকৃতিক বন ছিল। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক বন একবারে শূন্যের কাছাকাছি। এখানে ৯০-এর দশকের পর অনেক প্ল্যান্টেশন হয়েছে, বনের কাভারেজ বেড়েছে কিন্তু মানসম্মত বা যথাযথ বনায়ন হয়নি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর