মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
হলফনামার যত কথা

সরোয়ার-সাদিক ব্যবসায়ী, শিক্ষায় এগিয়ে মনিষা মাহবুব

রাহাত খান, বরিশাল

সরোয়ার-সাদিক ব্যবসায়ী, শিক্ষায় এগিয়ে মনিষা মাহবুব

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ৬ প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এগিয়ে বাসদের ডা. মনিষা চক্রবর্তী এবং খেলাফত মজলিসের একেএম মাহবুব আলম। মনিষা এমবিবিএস এবং মাহবুব আলম এমএ পাস। বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ার ও ওয়ার্কার্স পার্টির এ কে আজাদ বিএএলএলবি এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ওবায়দুর রহমান মাহবুব দাওরা হাদিস পাস। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাদিক আবদুল্লাহ স্ব-শিক্ষিত। শিক্ষার বিষয়ে এসব তথ্য জানা গেছে প্রার্থীদের হলফনামা থেকে। এ ছাড়া তথ্যে আরও জানা গেছে, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের দিক থেকে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন বিএনপির প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগের সাদিক আবদুল্লাহ। জানা গেছে, ৬ প্রার্থীর মধ্যে সর্বাধিক ১৮টি মামলা ছিল বিএনপির সরোয়ারের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ৫টি মামলা নিষ্পত্তি হলেও এখন পর্যন্ত বিচারাধীন রয়েছে ১৩টি।  প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সাদিক ও সরোয়ার পেশায় ব্যবসায়ী। ইসলামী আন্দোলনের ওবায়দুর রহমান মাহবুব পেশায় শিক্ষক, ওয়ার্কার্স পার্টির একে আজাদ আইনজীবী, বাসদের মনিষা চক্রবর্তী চিকিৎসক এবং খেলাফত মজলিসের মাহবুব আলম অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।

মজিবর রহমান সরোয়ার : বিএনপির মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, তার সর্বোচ্চ শিক্ষাগত  যোগ্যতা এলএলবি। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দায়ের হওয়া হত্যা, নাশকতা, দুর্নীতি, আয়কর ফাঁকি ও অবৈধ অর্থ উপার্জনের ১৮টি মামলার মধ্যে ৫টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এগুলোতে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে এখনো ১৩টি মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এ ছাড়া পেশায় ব্যবসায়ী সরোয়ারের ব্যবসার মূলধন ১ কোটি ৫ লাখ টাকা। কৃষি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান ভাড়া, ব্যবসা আর সন্মানী থেকে বছরে আয় ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৯৮৮ টাকা। এর মধ্যে ভাড়া থেকে ১২ লাখ, ব্যবসা থেকে ১০ লাখ এবং বছরে সন্মানী ভাতা পান ২৪ লাখ টাকা। নগদ টাকা আছে ১০ লাখ। শেয়ারবন্ডসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৮৫ লাখ টাকা। দুটি প্রাইভেট কার এবং একটি জিপসহ তিনটি গাড়ি আছে সরোয়ারের। হলফনামায় ৩টি গাড়ির মূল্য দেওয়া হয়েছে ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সাড়ে ১৩ লাখ টাকার আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী ছাড়াও আছে ৫০ তোলা সোনা। বিএনপি নেতা মজিবর রহমান সরোয়ারের রয়েছে তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র। এর মধ্যে ৩২ বোরের রিভলবার ১টি, ৭ এমএম রাইফেল ১টি এবং ২২ বোর রাইফেল ১টি। যার মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। রয়েছে ৬০ হাজার টাকা দামের একটি জিমনেশিয়াম মেশিন। টিভি, ফ্রিজ ও এসিসহ ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২০০ টাকার আসবাসপত্র রয়েছে তার। স্থাবর সম্পদের মধ্যে সরোয়ারের নামে ১৬ লাখ ৯ হাজার টাকা মূল্যের ৪ একর ৬৩ শতাংশ কৃষি জমি, ৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা মূল্যের তিনটি ফ্ল্যাট এবং ১টি টিন সেড বাড়ি আছে। ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো ঋণ নেননি সরোয়ার। হলফনামায় উল্লেখ না থাকলেও সরোয়ার বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি এবং দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব। তিনি ২০০৩ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম পরিষদের নির্বাচিত সাবেক মেয়র এবং সদর আসনের ৪ বারের সাবেক এমপি।

সাদিক আবদুল্লাহ : আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহ স্ব-শিক্ষিত বলে তার হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। যদিও তিনি এইচএসসি পাস বলে তার পারিবারিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহ রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দেওয়া হলফনামায় তার পেশা উল্লেখ করেছেন ব্যবসা। নিজেকে কান্তা কর্পোরেশন প্রাইভেট লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন তিনি। বাসা ভাড়া, ব্যবসা আর সন্মানী থেকে বছরে তার মোট আয় ৮ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা। নগদ অর্থ আছে ৬ লাখ ৮১ হাজার টাকা। সঞ্চয়পত্র আছে ২ লাখ টাকার। রিকন্ডিশন ১টি মাইক্রোবাস আছে। হলফনামায় সাদিকের কোনো স্বর্ণালঙ্কার কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  এছাড়া তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই বলেও হলফনামায় উল্লেখ আছে। সাদিকের নির্ভরশীলদের নামে ঢাকার পূর্বাচলে রাজউকের ১টি আবাসিক প্লট এবং গুলশানের নিকেতনে ১টি ফ্ল্যাট রয়েছে। যদিও প্লট ও ফ্ল্যাটের বাজার মূল্য হলফনামায় উল্লেখ করেননি তিনি। কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাদিকের কোনো ঋণ কিংবা দায়দেনা নেই।

ওবায়দুর রহমান মাহবুব : চরমোনাই পীর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত মেয়র প্রার্থী ওবায়দুল রহমান মাহবুব নগরীর আমানতগঞ্জ মাহমুদিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম (অধ্যক্ষ)। দাওরা হাদীস পাস মাহাবুবের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই। মাদ্রাসায় শিক্ষকতা বাবদ বছরে ২ লাখ ১৬ হাজার ৬০০ টাকা বেতন পান। আছে ৬ শতাংশ জমির ওপর টিনসেড ঘর, ৮ তোলা স্বর্ণালঙ্কার, ২টি ফ্রিজ ও একটি মোটর সাইকেল। একটি বন্দুকও আছে মাহবুবের। ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো ঋণ কিংবা দায়দেনা নেই তার।

একেএম মাহবুব আলম : খেলাফত মজলিসের মেয়র প্রার্থী একেএম মাহবুব আলম হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা এমএ পাস উল্লেখ করেছেন। একটি বেসরকারি কলেজ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে সদ্য অবসর নেওয়া মাহবুব আলম খেলাফত মজলিসের মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই। চাকরিকালীন বছরে ভাতা পেয়েছেন ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫০ টাকা। ব্যাংকে জমা আছে ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৭৫০ টাকা। স্ত্রীর নামে আছে ৮ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। যৌথ মালিকানায় তার ৬ একর কৃষি এবং অকৃষি ৯ শতাংশ জমিতে রয়েছে আধাপাকা টিনসেড ঘর। মাহবুব আলমের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা কিংবা কোনো ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো ঋণ এবং দায়দেনা নেই।

আবুল কালাম আজাদ : কমিউনিস্ট পার্টির মেয়র প্রার্থী, জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি আবুল কালাম আজাদের (একে আজাদ) শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ এলএলবি। ভূমিহীন একে আজাদের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই। পেশায় আইনজীবী এই প্রার্থীর বছরে আয় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বলতে নগদ জমা আছে ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা। টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, খাট সোফা, আলমিরা ছাড়াও আর ৭ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো সম্পদ নেই একে আজাদের। কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ কিংবা দায়দেনা নেই।

ডা. মনিষা চক্রবর্তী : বাসদের মেয়র প্রার্থী ডা. মনিষা এমবিবিএস পাস। পেশায় একজন চিকিৎসক উল্লেখ করা হয়েছে। তবে চিকিৎসা জনসেবা হিসেবে নেওয়ায় এই খাতে তার কোনো আয় উল্লেখ করেননি। জেলা বাসদের সদস্য সচিব ডা. মনিষা শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বেশির ভাগ সময় যুক্ত থাকেন। দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাঁধাদান ও পুলিশের উপর হামলার দুটি মামলা আদালতে বিচারধীন আছে। আর্থিক ক্ষেত্রে নগদ দেড় লাখ টাকা আছে মনিষার। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। এছাড়া ৫ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র ও ৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার আছে। কৃষি-অকৃষি কোনো জমি নেই। নেই কোনো ব্যাংক ঋণ কিংবা দায়দেনা। পারিবারিকভাবে থাকা ৫ লাখ টাকা সঞ্চেরপত্রের একজন অংশীদার তিনি। এছাড়া অর্ধেকভাগে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৯০০ টাকার আরও একটি সঞ্চয়পত্র রয়েছে ডা. মনিষার। ৬ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে মনিষা সর্বকনিষ্ঠ। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী তার জন্ম ১৯৯০ সালের ৫ এপ্রিল। টিআইবি’র আদলে বরিশালে গঠিত সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) এবং প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তার হলফনামায় প্রার্থীদের দেওয়া তথ্য ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা উচিত। প্রয়োজনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দুদকের সহযোগিতা নিতে পারেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মানবেন্দ্র বটব্যাল আরও বলেন, কেউ যদি হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা হবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. মুজিবুর রহমান জানান, স্বল্প সময় প্রার্থীদের বিস্তারিত হলফনামা খতিয়ে দেখা যায় না। যতটুকু সময় পেয়েছেন তার মধ্যে চেষ্টা করেছেন সবার হলফনামার তথ্য নির্ভুলভাবে যাচাই-বাছাই করার। যাচাই-বাছাইতে মেয়র প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের কোনো অসঙ্গতি পাওয়া যায়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর