মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর রাইস কয়েন

মির্জা মেহেদী তমাল

ভয়ঙ্কর রাইস কয়েন

প্রযুক্তিগত সেবা প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তোফাজ্জল হোসেন মোল্লা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগত সেবা দেয় তার কোম্পানি। এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক সোহরাব হোসেনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে তারা একসঙ্গে দীর্ঘ সময় আড্ডা দিতেন। অনুষ্ঠানে যেতেন। সময় কাটাতেন। অল্প সময়েই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক দিন এক আড্ডায় তোফাজ্জল হোসেন কথায় কথায় ‘রাইস কয়েন’-এর কথা বলেন শিল্পপতি সোহরাব হোসেনকে। তোফাজ্জল হেসে তাকে বলেন, ‘বড় ভাই ইউরেনিয়াম সম্পর্কে আপনার ধারণা নিশ্চয় আছে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ ইস্ট ইন্ডিয়া  কোম্পানি আমলের এই ম্যাগনেটিক কয়েনের ব্যাপক চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে। শত কোটি টাকায় এই কয়েন কিনে নেবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা নাসা (ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)। এসব কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে শোনেন শিল্পপতি সোহরাব। তিনি বলেন, এসব কয়েন এখন আর পাওয়া যায় না। যদিও এগুলো অনেক দামি। শিল্পপতির মুখে এমন কথা শুনে তার কথা এগিয়ে নেন তোফাজ্জল। তিনি বলেন, ‘আরে সে কথাই তো বলছি বড় ভাই। এমন কয়েনের খোঁজ আছে আমার কাছে। কিন্তু ওরা ক্রেতা পাচ্ছে না। তাছাড়া ওদের যোগাযোগও তেমন নেই। টাকা থাকলে আমি নিজেই নিয়ে নিতাম।’ এ কয়েন তিনি কম দামে জোগাড় করতে পারবেন। বড় বিনিয়োগকারী দরকার। তোফাজ্জলের কথায় আগ্রহ হয় শিল্পপতির। ওই শিল্পপতি তার কাছে সেই কয়েনের কথা জানতে চান। এক পর্যায়ে সেই কয়েন দেখতে চান শিল্পপতি। এর কয়েক দিন পর সেই কয়েনসহ হাজির তোফাজ্জল। সঙ্গে আরও লোকজন। তোফাজ্জল শিল্পপতির সঙ্গে সেই লোকজনের পরিচয় করিয়ে দেন। এদের মধ্যে একজন বিজ্ঞানীও ছিলেন। তার নাম ড. মোজাফফর। এই বিজ্ঞানী সেই কয়েনের নানা ক্যারিশমা দেখান। ভাতের চাল কয়েনের সামনে রাখেন। চুম্বকের মতো কয়েনটিকে আকর্ষণ করে চাল। শিল্পপতির চোখ ছানাবড়া। বিজ্ঞানী শিল্পপতিকে জানান, এটি শত কোটি টাকার সম্পদ! এ কথা শুনে শিল্পপতি লোভে পড়ে যান। শত কোটি টাকার সম্পদ! এরপর শিল্পপতি দরকষাকষি শুরু করেন। পাঁচ কোটি টাকা দাবি বিক্রেতাদের। শেষে রফা হয় এক কোটি ৪০ লাখে। তোফাজ্জলের কথায় বিশ্বাস করে কয়েন বুঝে পাওয়ার আগেই গাড়িবোঝাই করে টাকা দিয়ে দেন শিল্পপতি। টাকা নিয়ে তারা দ্রুত সেখান থেকে চলে যান। পরে শিল্পপতি দেখেন, তাকে যে কয়েন দেওয়া হয়েছে সেটা আসলে নাটবল্টুর ওয়াসার বা ছোট চাকতি। এতে বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। লোকলজ্জা ও প্রশাসনের জবাবদিহির ভয়ে ওই শিল্পপতি প্রথমে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করেন। কাঁচামাল সরবরাহ করার নামে প্রতারণার অভিযোগে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। ওই মামলার তদন্ত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বের করে আসল ঘটনা। সিআইডি জানতে পারে, ‘রাইস কয়েনের’ নামে কোটি টাকার প্রতারণা করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এরই মধ্যে এ চক্রের ৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং পাঁচটি মামলার তথ্য পায় সিআইডি। সিআইডি তদন্তে নামার পর লালমাটিয়া এলাকা থেকে তোফাজ্জলকে গ্রেফতার করে। এরপর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে আটক করা হয় বিজ্ঞানী ও ব্যবসায়ী পরিচয় দেওয়া আবুল কালাম আজাদ ওরফে শ্যামল ওরফে কাইউম ওরফে ড. মোজাফফর (৪৮) নামের আরেক প্রতারককে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে-বিদেশে আটটি প্রতিষ্ঠানের ১২টি পদে থাকার পরিচয় দেন এই আবুল কালাম ওরফে ড. মোজাফফর। গুজরাট ও মালয়েশিয়ায় তার ব্যবসা আছে বলেও দাবি করেন তিনি। ভয়ঙ্কর এই প্রতারক সহযোগীদের নিয়ে সুইস ব্যাংক থেকে সুইফট কোড হ্যাকড করে ৩৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এ অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করেছে। আবুল কালামের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই পাওয়া গেছে ৬০ লাখ টাকা। সিআইডি জানায়, কথিত এই রাইস কয়েনের ‘আবিষ্কারক’ গোলাম মাওলা নামের এক প্রতারক। এ ছাড়া আমিন, তুহিন, নজরুল ইসলাম, আলমগীরসহ আরও এক ডজন ব্যক্তি এ চক্রে জড়িত। জানতে চাইলে সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, ‘এই চক্রটি অভিনব পন্থায় রাইস কয়েনের নামে প্রতারণা করে। এরা আরও প্রতারণা করেছে। অনেকে লজ্জা ও ভয়ে অভিযোগ করেনি। জানাজানি হলে হয়তো আরও অভিযোগ পাওয়া যেতে পারে। এদের ব্যাপারে আমরা তদন্ত করছি।’ সিআইডি সূত্র জানায়, তোফাজ্জল হোসেন মোল্লা (৪৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। পরে সফটওয়্যারের কাজ করছেন। গত বছরের ২৩ অক্টোবর তিনিসহ ১১ জন মিলে ওই শিল্পপতির কার্যালয়ে গিয়ে প্রতারণা করেন। তাদের ফাঁদে পড়ে শিল্পপতি তার এনআরবিসি ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলে দেন। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে ওই বছরের ১৯ নভেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলা করেন ওই শিল্পপতি। প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়া বিশাল অঙ্কের অর্থে অভিযুক্ত তোফাজ্জল দীর্ঘদিন ধরে রাজসিক জীবনযাপন করছেন। মোহাম্মদপুর এলাকায় তার ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া প্রায় ৪৫ হাজার টাকা, ব্যাংকে ২৫ লাখ টাকার এফডিআরসহ রয়েছে বিপুল পরিমাণে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি। দুই সন্তানকে স্কলাস্টিকার মতো ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করানোসহ দেশের বাইরে পরিবার নিয়ে তার প্রমোদভ্রমণ রয়েছে বহুবার। একইভাবে প্রতারণার শিকার এক ব্যক্তি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানায় একটি মামলা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডি অর্গানাইজড ক্রাইমের একটি দল প্রতারক চক্রের মূল হোতাসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে। এ মামলার তদন্তকালে সিআইডি জানতে পারে এ প্রতারক চক্র আবারও প্রতারণা করার জন্য সংঘবদ্ধ হচ্ছে। এবার তাদের টার্গেট ২ কোটি টাকা হাতানো। তারা তাদের প্রতারণার জাল বিছিয়ে ফেলেছে। আর সিআইডি ফাঁদ পাতে প্রতারকদের হাতেনাতে ধরার জন্য। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, সোর্সসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে সিআইডি তাদের মিটিং পয়েন্ট একেবারে রিয়েলটাইমে শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে ৬ আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। সে সময়ে তারা তাদের আসন্ন প্রতারণা নাটকে কে কোন ভূমিকায় অভিনয় করবে তা নিয়ে আলোচনা করছিল।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর