বৃহস্পতিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

উপহাস বলছেন শ্রমিকরা, গার্মেন্ট বন্ধের শঙ্কা মালিকদের

গার্মেন্টে মজুরি বৃদ্ধি

জিন্নাতুন নূর

গার্মেন্ট শ্রমিকদের জোরালো দাবির মুখে অবশেষে মালিকপক্ষ ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করতে রাজি হয়েছেন, যা সর্বশেষ মজুরি থেকে মাত্র এক হাজার ৬০ টাকা বেশি। এতে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দাঁড়াবে ছয় হাজার ৩৬০ টাকা বা ৭৬ ইউএস ডলার। কিন্তু শ্রমিকরা মালিকদের এই প্রস্তাবে নাখোশ। শ্রমিকদের দাবিকৃত মজুরির পরিমাণ মালিকপক্ষের প্রস্তাবিত দাবির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। আর এই দাবি বাস্তবায়নে এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকরা র‌্যালি ও মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছেন। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা করার দাবি আদায়ে ঈদের পর জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতারা। শ্রমিক নেতারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছেন, মালিকদের প্রস্তাবিত মজুরির মাধ্যমে শ্রমিকদের সঙ্গে ‘উপহাস’ করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের উসকে দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। আর বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, ছোট কারখানাগুলোর মালিকপক্ষের প্রস্তাবিত মজুরির চেয়ে বেশি মজুরি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। বেশি মজুরি দিতে হলে ছোট কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে।

শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আসছে কোরবানির ঈদের আগে আন্দোলন করলে কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই করা হতে পারে—এমন আশঙ্কায় ঈদের পর তারা জোরালো আন্দোলনে যাবেন। যদিও মজুরি বোর্ডের বৈঠকে শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে মজুরি বৃদ্ধি করে তা ১২ হাজার ২০ টাকা বা ১৪৩ ইউএস ডলার করার দাবি জানানো হয়। তবে শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করছেন বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে যাকে পাঠানো হয়েছে তিনি সরকারদলীয় শ্রমিক সংগঠনের নেতা। তার দেওয়া প্রস্তাব তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।

অন্যদিকে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের মজুরি নির্ধারণের জন্য সময় ছয় মাস। ১৮ আগস্ট এই ছয় মাস পূর্ণ হবে। কিন্তু বোর্ডের এই কাজ শেষ করতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এ জন্য মজুরি বোর্ড কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে আরও তিন মাস সময় বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাবও দিয়েছে। শ্রমিক নেতারা বলছেন, ‘মজুরি বোর্ডের কাজ মজুরি নিয়ে দরকষাকষি করা নয়। মজুরি বোর্ড কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজারের পাইকারি দোকানও নয়। এই বোর্ডের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে আমাদের লাখ লাখ পোশাকশ্রমিকের জীবন। এ জন্য বোর্ডের বিবেচনা সুষ্ঠু হতে হবে। আর মজুরি বোর্ড গঠিত হওয়ার ছয় মাসের মাথায় এটি নির্ধারণে বাধ্যবাধকতা থাকে। কিন্তু এবার মজুরি বোর্ড গঠনের পর থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, প্রথম থেকে সময় নষ্ট করার এক ধরনের পদ্ধতি নেওয়া হচ্ছে।’ সাধারণত সরকারের শ্রম আইনের ১৪১ ধারা অনুযায়ী অন্তত ১০টি প্যারামিটার বিবেচনা করে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। যেখানে একজন শ্রমিক প্রতিনিধি, মালিকপক্ষের প্রতিনিধি এবং নিরপেক্ষ প্রতিনিধি থাকবেন। সবার কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাব নিয়ে শ্রম আইনের নির্ধারিত মাপকাঠি অনুযায়ী একটি মজুরি নির্ধারণ করা হবে। অথচ ২০১৩ সালে পোশাকশ্রমিকদের জন্য সর্বশেষ যে মজুরি নির্ধারণ করা হয় শ্রমিকরা সেটিও মেনে নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। এরপর শ্রমিকদের জীবনমানের পরিবর্তন হয়নি বরং তারা আরও দরিদ্র হয়েছেন। এর মধ্যে শ্রমিকরা কয়েকবার বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনও করেছেন। অন্যদিকে মালিকরা গার্মেন্ট ব্যবসার অবস্থা খারাপ হবে এমন কথা বলে এলেও ২০১৩ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত গার্মেন্ট ব্যবসা ৩১ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় রূপ নিয়েছে। অর্থাৎ বাস্তবে গার্মেন্টশিল্পের অনেক প্রসার হয়েছে। ২০১৩ সালে একজন শ্রমিক ৫ হাজার ৩০০ টাকায় যে জিনিস কিনতে পারতেন, সেই দ্রব্য বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী এবং সরকার-নির্ধারিত ৮.৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হিসেবে কিনতে হলে এর দাম দাঁড়াবে সাত হাজার ৮০০ টাকা প্রায়। অর্থাৎ এ হিসাবে মালিকপক্ষের প্রস্তাবিত মজুরি ২০১৩ সালের চেয়েও কম। বিজিএমইএর প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মইনুদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। শ্রমিক, মালিক ও সরকার মিলে সুন্দরভাবে বিষয়টির সমাধান হওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। কিন্তু দেশের পোশাক খাতকে যেহেতু গ্লোবাল মার্কেটে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে, এ জন্য এ শিল্প যাতে টিকে থাকে সেভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ শিল্প নিয়ে বেশ সহনশীল। মালিক-শ্রমিক উভয়ের স্বার্থ যাতে সংরক্ষণ হয় সেভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজ্জেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শ্রমিকদের অসহায়ত্ব ও তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে তাদের উপহাস ও তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। মালিকপক্ষ পরিকল্পিতভাবে আলোচনাকে এমন স্থানে নিয়ে যেতে চাইছেন, যাতে তারা বিপন্ন বা বিরক্ত হন। অর্থাৎ এখানে যুক্তিসংগত আলোচনার কোনো পরিবেশ আর থাকছে না। সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত মিল-কারখানার মজুরি ধরেছে আট হাজার ৩০০ টাকা। এটি বেসিক বেতন হলে রাষ্ট্রায়ত্ত মিল কারখানার একজন শ্রমিকের মোট বেতন হয় প্রায় ১৮ হাজার টাকা। তাহলে গার্মেন্টশ্রমিকরা কেন বঞ্চিত হবেন। বরং অবাস্তব প্রস্তাব দিয়ে শ্রমিকদের বিক্ষুব্ধ করে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। আর তারা রাস্তায় নেমেছেন এ অজুহাতে পরে তাদের ওপর দমন-নীতি চালানো হবে। তাদের আন্দোলনকে একপর্যায়ে ‘ষড়যন্ত্র’ বলেও চালানো হবে, যা অনেকটা পরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে। বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম মান্নান কচি বলেন, ‘দেশে ছোট-বড় উভয় ধরনের গার্মেন্ট কারখানা আছে। সর্বশেষ যে ন্যূনতম মজুরি আমরা প্রস্তাব করেছি তাতে শ্রমিক ও মালিক উভয়ের স্বার্থ দেখা হয়েছে।’

 শ্রমিকদের দাবি করা মজুরি বড় গার্মেন্টগুলো দিতে পারলেও ছোটগুলো তা দিতে পারবে না। শ্রমিকদের দাবিকৃত মজুরি দিতে গিয়ে এ ধরনের গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা চাই না যে, কোনো গার্মেন্ট বন্ধ হোক আর কোনো শ্রমিক চাকরিহারা হোক। এ জন্য শ্রমিক ও মালিকপক্ষের উভয়ের কথা শুনে মজুরি বোর্ড যে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবে আমরা তা মেনে নেব।’

সর্বশেষ শ্রমিকদের আন্দোলনের দাবিতে মজুরি কমিশন ২০১৩ সালে ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে। এরপর মুজরি বৃদ্ধির জন্য নতুন বোর্ড গঠন করা হয়, যেখানে মালিকরা ন্যূনতম মজুরি ছয় হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়। এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ প্রায় ১৯ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রস্তাব পর্যালোচনা করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড।

সর্বশেষ খবর