সামসুল ইসলাম গাবতলী পশুর হাট থেকে কোরবানির একটি গরু কিনেছেন। ৮০ হাজার টাকা দিয়ে তিনি বেশ মোটা নাদুসনুদুস গরু পেয়ে ভিষণ খুশি। বিশাল আকারের এই গরুটি তিনি একটি ট্রাকে করে ফার্মগেটের বাসায় ফেরেন। ঈদের আর বাকি আছে ৩ দিন। মহল্লার লোকজনও গরু দেখে বলছে ভালো। বাসার দারোয়ানের ওপর দায়িত্ব দেখভালের। খড়, ঘাস, ভুসি, মার দেওয়া হলো গরুকে খেতে। কিন্তু গরু খায় না। কেমন যেন ঝিমুনি ঝিমুনি ভাব। পরদিন বাসার নিচে চিৎকার চেঁচামেচিতে সামসুল ইসলামের ঘুম ভাঙে। দারোয়ান তার ফ্ল্যাটে এসে চিৎকার করে বলছে, স্যার তাড়াতাড়ি আসেন। গরু যেন কেমন করছে। সামসুল ইসলাম দ্রুত ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে নিচে নামছেন সিঁড়ি দিয়ে। ইতিমধ্যে গ্যারেজে লোকজনের ভিড়। মাঝে গরু পড়ে রয়েছে। মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। গরুটি আর বেঁচে নেই। আস্ত গরু আর কোরবানি দেওয়া হয়নি সামসুল ইসলামের। ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে দুটি ছাগল কিনে আনেন মানিকমিয়া এভিনিউয়ের রাস্তার ওপর থেকে। পরে জানা গেল, মোটাতাজাকরণের জন্য গরুকে ক্যাটেল কেয়ার, ইনজ্যাইভিট, এনোরা, সেটরনসহ বিভিন্ন বিষজাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। যে কারণে মৃত্যু হয় গরুটির। কোরবানি উপলক্ষে অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার জন্য গরুকে পাম ট্যাবলেট, স্টেরয়েড ও ডেক্সামেথাসনের মতো ভয়ংকর ক্ষতিকারক ওষুধ খাইয়ে ফুলিয়ে ফেলছেন। বিষাক্ত রাসায়নিকের হাইডোজ প্রয়োগ করে অল্প দিনে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তাজা করা হচ্ছে অবলা এই পশুকে। অতি দ্রুত এক সপ্তাহের ভিতরে গরু মোটাতাজা করার জন্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্যারেন্ট পাউডার খাওয়ানো হচ্ছে। বিষাক্ত হয়ে ওঠা এসব গরুর মাংস খেলে লিভার, কিডনি, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্তসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জানা যায়, গরুকে প্রথমে ভিটামিন-জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হয়। এর ১০-১৫ দিন পর হেমোটফিন বিএস ১০ এমএল ইনজেকশন মাংসপেশিতে প্রয়োগ করা হয়। পশুকে ওরাডেকশন ইনজেকশনও দেওয়া হচ্ছে। ওরাডেকশন জাতীয় ইনজেকশন একসঙ্গে ২০-৩০টি প্রয়োগ করলে গরুর কিডনি অকেজো হতে থাকে। এরপর গরু দ্রুত মোটা হতে থাকে। এ ছাড়া মোটাতাজাকরণের জন্য কৃমিনাশক, ক্যাটোফসসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্ররোচনায় ফাঁদে পা দিচ্ছেন গরু বিক্রেতারা। গাবতলীর একটি ডেইরি ফার্মের মালিক ইসলাম জানান, কতিপয় ব্যবসায়ী সাধারণ খাবারের সঙ্গে দ্রুত মোটা করতে গরুকে ক্যাটেল কেয়ার, ইনজ্যাইভিট, এনোরা, সেটরনসহ বিভিন্ন বিষজাতীয় ওষুধ খাওয়াচ্ছে। এসব ওষুধের মাধ্যমে মোটাতাজা গরু ৪০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে জবাই করা না হলে তা এমনিতেই মারা যায়। জানা গেছে, আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে চলছে গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের কাজ। আর এতে ব্যবহার করা হচ্ছে পাম ট্যাবলেট, স্টেরয়েড ও ডেক্সামেথাসনের মতো ভয়ানক ক্ষতিকারক ওষুধ। যা ব্যবহারে মানবদেহের জন্য রয়েছে চরম ঝুঁকি। বেশি লাভের আশায় অনেক খামারি পশুচিকিৎসকদের পরামর্শ না মেনে গরুকে স্টেরয়েড দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই হাতুড়ে চিকিৎসক ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি প্ররোচনা দেয়। বিষাক্ত রাসায়নিকের হাইডোজ প্রয়োগ করে অল্পদিনে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তাজা করা এসব গরুর মাংস খেলে লিভার, কিডনি, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্তসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিবছর কোরবানির ঈদ সামনে রেখে কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজাকরণের এই কর্মযজ্ঞ চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরুকে নিয়মমাফিক স্বীকৃত ফর্মুলা অনুসারে খাদ্য দিয়ে মোটাতাজা করলে তার মাংস ক্ষতির কারণ হয় না। কিন্তু স্টেরয়েড দিয়ে মোটা করা গরুর মাংস ক্ষতিকর। স্টেরয়েড মূলত হাঁপানির চিকিৎসায় ব্যবহূত হয়। কিন্তু এ জাতীয় ওষুধ, যেমন ডেক্সামেথাসন বা ডেকাসন, বেটামেথাসন ও পেরিঅ্যাকটিন অতিরিক্ত মাত্রায় দিলে গরুর কিডনি ও যকৃতের কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ায় শরীর থেকে পানি বের হতে পারে না। এ কারণে শোষিত হয়ে পানি সরাসরি গরুর মাংসে চলে যায়। ফলে গরুকে মোটা দেখায়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর জানায়, গরু মোটাতাজাকরণ একটি নিয়মিত ও প্রচলিত পদ্ধতি। এটি একটি স্বল্পমেয়াদি লাভজনক পদ্ধতি। প্রাকৃতিক এ পদ্ধতি যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। যুব উন্নয়ন অধিদফতর ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে গরু মোটাতাজাকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে গরু মোটাতাজা করে হাজার হাজার বেকার যুবক স্বাবলম্বী হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগ এ জন্য গরুর খামারিদের দুই থেকে আড়াই কেজি বিশেষ পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত ইউরিয়া, লালিগুড় ও খড়ের একটি বিশেষ ধরনের মিকচার খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়। আট দিন কোনো পাত্রে এ মিকচার বন্ধ করে রেখে তা রোদে শুকিয়ে গরুকে খাওয়াতে হয়। তিন মাস ধরে এটা খাওয়ালে গরু খুব দ্রুত মোটাতাজা হয়ে ওঠে। অথচ কিছু পশুচিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত মোটাতাজা করতে ক্যাটাফস, বার্গাফ্যাট, বায়োমিঙ্গ খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, কৃষকদের নিয়মমাফিক উপায়ে মোটাতাজাকরণে উদ্বুদ্ধ করলেও অনেকে দ্রুত ফল পাওয়ার আশায় গরুকে বড়ি খাওয়ায়। অভিযোগ রয়েছে, এই বড়ি ভারত ও পাকিস্তান থেকে অবৈধভাবে আসে বিভিন্ন ওষুধের দোকানসহ গো-খাদ্য বিক্রেতাদের দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে।
দেশর পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ ও ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে ক্ষতিকর নানা ওষুধ ও রাসায়নিক সেবনের মাধ্যমে এখন গরু মোটাতাজা চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর দেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতেই অন্তত এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের আড়াই লক্ষাধিক গরুকে অবৈধ পন্থায় মোটাতাজাকরণ করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জেও লক্ষাধিক ষাঁড় মোটাতাজা করে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানান, রাসায়নিকে মোটাতাজা করা গরুর মাংস খেলে মানবদেহে সরাসরি ক্ষতিকর স্টেরয়েডের প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। এ মাংস গ্রহণের ফলে দুর্বল লিভার ও কিডনি রোগীর সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি হয়।