সোমবার, ২০ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাহাড়ে ২১ বছরে ১০৮৩ খুন

কবির হোসেন সিদ্দিকী, বান্দরবান

পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২০ বছর পার হলেও পার্বত্য অঞ্চলে চলছে এখনো অস্ত্রের ঝনঝনানি, অপহরণ ও চাঁদাবাজি। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে পার্বত্য অঞ্চলে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ-অসহায় মানুষ। সরকারি সূত্র মতে, পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘাতে নিহতের সংখ্যা ১০৮৩, আহত হয়েছে ১৩৮২ জন, অপহরণ হয়েছে ৩৫৩৮ জনের বেশি। ২০১৮ সালেই তিন পার্বত্য জেলায় ৪৮ জন নিহত হয়েছে, ১৩৭ অপহূত, বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে শতাধিকেরও বেশি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে গ্রেফতার হয়েছে ১৬৫ জন। সর্বশেষ গত শনিবার সকালে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে কর্মসূচি পালনের জন্য জড়ো হতে থাকা ইউপিডিএফ সদস্যদের লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। এলোপাতাড়ি গুলিতে সাতজন নিহত ও তিন জন আহত হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধানে আলোচনা শুরু করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য সশস্ত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে শান্তিবাহিনীর ৭৩৯ সদস্যের প্রথম দলটি সন্তু লারমার নেতৃত্বে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্রসমর্পণ করে। আত্মসর্মপণের দিনই পাহাড়িদের একটি অংশ চুক্তির বিরোধিতা করে অনুষ্ঠানস্থলে চুক্তিবিরোধী প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে। এরপর চুক্তির বিরোধিতা করে প্রসীত খিসার নেতৃত্বে জন্ম নেয় ইউপিডিএফ। চুক্তির কয়েক বছর যেতে না যেতেই চুক্তির পক্ষের জনসংহতি সমিতি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একইভাবে ইউপিডিএফও দুইভাবে বিভক্ত হয়। এরপর থেকে ৪ ভাগের পাহাড়ি সংগঠনের মধ্যে শুরু হয় ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। পার্বত্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পক্ষগুলোর মধ্যে সংঘাত যতটা না আদর্শিক কারণে, তারচেয়ে বেশি এলাকার দখলদারিত্ব, দখল নিয়ন্ত্রণে রাখা, চাঁদাবাজির পয়েন্টগুলো নিয়ন্ত্রণ, বিশাল সশস্ত্র গ্রুপের কর্মীদের ভরণপোষণের ব্যয়ভার আদায়, প্রতিপক্ষের কর্মসূচিতে বাধা প্রদান-পাল্টা প্রতিরোধ এসবই তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিরোধের কারণ। খাগড়াছড়ির           প্রায় পুরো জেলায়ই ইউপিডিএফের শক্ত নিয়ন্ত্রণ। সব উপজেলায়ই বিশাল কর্মী-সমর্থক বাহিনী। তবে দীঘিনালা, মানিকছড়ি, রামগড়, গুইমারা ও লক্ষ্মীছড়িতে মাঝে মাঝেই আক্রমণ চালায় জনসংহতি ক্যাডাররা। এসব উপজেলায় তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমও আছে। পুরো জেলায় ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও প্রায় প্রতিটি উপজেলায়ই কমবেশি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড আছে জনসংহতির। আবার খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, দীঘিনালা উপজেলায় শক্ত অবস্থানসহ সব উপজেলায়ই জেএসএস (এমএন লারমা)’র কার্যক্রম আছে। বান্দরবান জেলা সদরের বালাঘাটায় ঘাঁটি গেড়ে সদরের কিছু অংশ, রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চালায় ইউপিডিএফ। এছাড়া পুরো জেলায় নিয়ন্ত্রণ মোটামুটি জনসংহতি সমিতির হাতেই। এই জেলায় এমএন লারমা গ্রুপের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। আর রাঙামাটিতে দুটি পক্ষই সমানে সমান। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও পাহাড়িদের চারটি রাজনৈতিক দলই সশস্ত্র কর্মী পোষে। রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী, যারা নিজ নিজ দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে সশস্ত্র ক্যাডার ও অস্ত্রের দিক দিয়ে স্পষ্টতই এগিয়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি। পাহাড়ের প্রাচীন এই সংগঠনের প্রশিক্ষিত সাবেক গেরিলাদের প্রায় সবাই আর্থিক সক্ষমতা, বিদেশি কানেকশন ও সামাজিক কাঠামোয় শীর্ষে। সশস্ত্র লড়াইয়ে তারাই পাইওনিয়ার। তাদের সশস্ত্র ক্যাডাররা জলপাইরঙের পোশাক ব্যবহার করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময় আটক হওয়া ক্যাডারদের এই পোশাকেই দেখা গেছে। দুই যুগের গেরিলা লড়াইয়েও তারা এই পোশাক ব্যবহার করতেন। অস্ত্রের সক্ষমতায় দ্বিতীয় অবস্থানে ইউপিডিএফ। মূলত তরুণ ছাত্র ও যুবকদের এই সংগঠনটি সশস্ত্রভাবে বেশ উন্নত অস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ মজুদ থাকা সত্ত্বেও জনসংহতির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই পেরে উঠে না মূলত অভিজ্ঞতার অভাবে। নানা উপায়ে তারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ ঠিকই সংগ্রহ করে নেয় কিন্তু আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণের অভাব, অনভিজ্ঞতা আর সশস্ত্র জীবনের প্রতি তরুণদের অনাগ্রহের কারণে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। অস্ত্রের লড়াইয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে জনসংহতি (এমএন লারমা)। তাদের সঙ্গেও বেশ কিছু সাবেক গেরিলা সম্পৃক্ত থাকলেও অস্ত্র ও অর্থের দিকে পিছিয়ে থাকায় খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না তারা। সম্প্রতি অস্ত্রের চালান আনতে গিয়ে ভারতের মিজোরামে গ্রেফতার হন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতা অংশুমান চাকমা। হাতছাড়া হয় অস্ত্রের চালানটিও। ফলে গত দুই বছরে বিভিন্ন আক্রমণে জনসংহতির হাতে তাদের সুদীর্ঘ চাকমাসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতা-কর্মী নিহত হলেও পাল্টা কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি তারা। তাই সশস্ত্র লড়াইয়ে একেবারেই ইউপিডিএফের মুখাপেক্ষী এই সংগঠনটি। খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আলী আহমদ খান জানান, ‘আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বেই পাহাড়ে হামলা-পাল্টা হামলা থাকতে হয়।’ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র নিরন চাকমা বলেন, জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের নেতা তারিন্দ্র লালের (পেলে) নেতৃত্বে পাহাড়ে হামলার ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ অস্বীকার করে জেএসএস (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক প্রশান্ত ত্রিপুরা বলেন, ইউপিডিএফ হচ্ছে চুক্তিবিরোধী সংগঠন। তারা সব সময় পাহাড়কে অশান্ত রাখতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে। তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে পাহাড়ে খুনের ঘটনা বাড়ছে। চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, পাহাড়ে যে চারটা সংগঠন আছে তারা অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। নির্বাচন সামনে আসছে। সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পেছনে নির্বাচনের আগে নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি থাকতে পারে। তিনি আরও জানান, গোয়েন্দা পুলিশসহ বিশেষ শাখার লোকজনকে সহিংসতা রোধে ও নজরদারি রাখার ক্ষেত্রে সতর্কভাবে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর