সোমবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা
কৃষি

পেয়ারা-আমড়ার ভাসমান বাজার

রাহাত খান, বরিশাল

পেয়ারা-আমড়ার ভাসমান বাজার

বাংলার আপেল-খ্যাত ‘পেয়ারা’ আর ‘আমড়া’ ঘিরে এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুরিয়ানা এলাকায়। বাগান থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে পেয়ারা আর আমড়া সংগ্রহ এবং নৌকায় নিয়ে ভাসমান পাইকারি বাজারে বাজারজাত করায় ব্যস্ত হাজার হাজার কৃষক।

ভরা মৌসুমে ঐতিহ্যবাহী পেয়ারা আর আমড়ার বাগান এবং নৌকায় বাজারজাত প্রাচীন পদ্ধতি হলেও পুরো এই প্রক্রিয়া ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। মৌসুমের এই সময়ে প্রতিদিন ছোট ছোট নৌকায় পেয়ারা আর আমড়া বাগান ছাড়াও খালে এবং ভাসমান বাজারে ঘুরে বেড়াতে প্রতিদিন আটঘর-কুরিয়ানায় আসছেন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক। পেয়ারা-আমড়া আর ভাসমান বাজার ঘিরে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ওই এলাকার অর্থনীতি।

নেছারাবাদ উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্ব সীমান্তে আটঘর-কুরিয়ানার অবস্থান। স্থানীয় প্রবীণদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রাহ্মণকাঠি গ্রামের পূর্ণচন্দ্র ও কালাচাঁদের হাত ধরে ভারত থেকে এ এলাকায় পেয়ারার আগমন ঘটে। এরপর দ্রুত গোটা আটঘর-কুরিয়ানা ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে পেয়ারার চাষ। আটঘর-কুরিয়ানায় পেয়ারা চাষের ভিত্তি হলেও পেয়ারার চাষ এখন আর কুরিয়ানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বিস্তৃতি ঘটেছে আশপাশের বিভিন্ন উপজেলায়।

আটঘর কুরিয়ানা ইউনিয়নের ১৮টি গ্রাম, পাশের জলাবাড়ি ইউনিয়নের ৫টি, সমুদয়কাঠি ইউনিয়নের ২টি গ্রাম ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বানারীপাড়া উপজেলার ২টি ও ঝালকাঠি সদর উপজেলার ৫টিসহ মোট ৩৪টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে বিস্তীর্ণ পেয়ারার বাগান। এ ছাড়াও বানারীপাড়া উপজেলার সৈয়দকাঠি ইউনিয়নের ৪টি, বিশারকান্দি ইউনিয়নের ১টি, উদয়কাঠি ইউনিয়নের ২টি গ্রামেও সম্প্রতি গড়ে উঠেছে বিস্তীর্ণ পেয়ারার বাগান। প্রতি বছর শ্রাবণ ও ভাদ্র দুই মাস পেয়ারার ভরা মৌসুম। বিগত বছরের মতো এবারও বাম্পার ফলন হয়েছে পেয়ারার। প্রতি হেক্টরে এবার পেয়ারার ফলন হয়েছে ৯ থেকে ১১ টন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিরোজপুরের নেছারাবাদ, পার্শ্ববর্তী বরিশালের বানারীপাড়া ও ঝালকাঠি সদর উপজেলার ৩৪টি গ্রামের শতভাগ কৃষক পেয়ারা আর আমড়া চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। পেয়ারা আর আমড়া রাজ্যে নারী-পুরুষসহ সবাই এখন বাগানে গাছ থেকে পেয়ারা পাড়া এবং নৌকায় ভাসমান বাজারে নিয়ে বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

আটঘর কুরিয়ানার পেয়ারা চাষি বিজন মিত্র জানান, এবার প্রতি মণ পেয়ারা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় দিনের পেয়ারা বিক্রি করতে হয় দিনের মধ্যেই। এ কারণে প্রত্যাশিত দাম পাওয়া যায় না। পেয়ারা চাষে লাভের মুখ দেখতে ওই এলাকায় একটি সংরক্ষণাগার নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তিনিসহ অন্য চাষিরা।

এদিকে পেয়ারা থেকে ফলন এবং বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় কয়েক বছর ধরে ওই এলাকার কৃষকরা আমড়া চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। অনেকে পেয়ারা বাগান পরিষ্কার করে আমড়ার বাগান করছেন, আবার কেউ কেউ নতুন করে আমড়ার বাগান করছেন।

আটঘর-কুরিয়ানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখর কুমার সিকদার জানান, তিনি কয়েক বছরে পর্যায়ক্রমে ১০ বিঘা জমিতে আমড়ার বাগান গড়ে তুলেছেন। পেয়ারার রাজ্যে আমড়া চাষের বিষয়ে শেখর সিকদার বলেন, আমড়া চাষে ঝুঁকি কম। তেমন কোনো রোগবালাই নেই। ফলন হয় ৪ মাস (শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক)। পেয়ারার চেয়ে আমড়ার উৎপাদন এবং বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় চাষিরা দিন দিন পেয়ারা চাষ ছেড়ে আমড়া চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। 

ইউপি চেয়ারম্যান শেখর বলেন, এবার ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বৃষ্টি না হওয়ায় আমড়া গাছের অনেক ফুল ঝরে গেছে। এতে গত বারের চেয়ে ফলন কিছুটা কম হলেও বাজার মূল্য এবার বেশি হওয়ায় লাভের স্বপ্ন দেখছেন আমড়া চাষিরা। গত বছর প্রতি মণ আমড়া বিক্রি হয়েছিল ৫০০ টাকায়। এবার প্রতি মণ আমড়া বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা দরে। সবকিছু মিলিয়ে ফলন কম হলেও আমড়া চাষিদের মুখে ফুটেছে হাসি।

বরিশাল বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক তুষার কান্তি সমদ্দার বলেন, স্থানীয়ভাবে পেয়ারার বাজার মূল্য কম। তাছাড়া ছত্রাকের আক্রমণের কারণে পেয়ারার ফলন কম। এ কারণে পেয়ারা চাষে তেমন একটা লাভ করতে পারছেন না তারা। অন্যদিকে আমড়ার বাজার মূল্য এবং ফলন বেশি। এ কারণে পেয়ারা চাষের পাশাপাশি নতুন করে আমড়া চাষে ঝুঁকে পড়ছেন চাষিরা। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগে এবার মোট ৩ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা এবং ১ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে আমড়ার চাষ হয়েছে। কটুরাকাঠির পেয়ারা চাষি বঙ্কিম জানান, আটঘর কুরিয়ানার বিভিন্ন খালের তীরে ৮টি গালায় (বিক্রি করার স্থান) এবং বহু ভাসমান বিক্রয় কেন্দ্রে থাকলেও মূল ক্রয়-বিক্রয় হয় ভিমরুলী খালের ঐহিত্যবাহী ভাসমান বাজারে। এখান থেকে পেয়ারা-আমড়া কিনে বেপারিরা ট্রলারে এবং ট্রাকে করে নিয়ে যান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। জানা গেছে, খালে খালে নৌকা-ট্রলারে ঘুরে পেয়ারা আর আমড়া বাগান এবং ভিমরুলী ভাসমান বাজারের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে প্রতিদিন আসছেন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক। বছরের অন্যান্য সময় প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও সোমবার দুই দিন ভাসমান হাট বসে ভিমরুলী খালে। কিন্তু পেয়ারা আর আমড়ার মৌসুমে ভিমরুলী খালে বাজার বসছে প্রতিদিন। শ্রাবণ থেকে কার্তিক পর্যন্ত ৪ মাস জমজমাট থাকে ভিমরুলীর ভাসমান বাজার। প্রকৃতিপ্রেমীরা বিশেষ করে সপ্তাহের ছুটির দিনে ভোরে পৌঁছাচ্ছেন আটঘর-কুরিয়ানা এলাকায়। সারা দিন নৌকা-ট্রলারে বাগান দর্শন ছাড়াও ঘুরে বেড়ান খালে খালে। এতে ওই এলাকায় সৃষ্টি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটকের আনাগোনায় ওই এলাকার শত শত নৌকা-ট্রলারের মালিক এবং মাঝিরাও আয় করছেন হাজার হাজার টাকা। এ ছাড়া পর্যটকদের খাওয়া-দাওয়া এবং কেনাকাটার কারণেও চাঙ্গা ওই এলাকার অর্থনীতি।

সর্বশেষ খবর