রবিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

টার্গেট বিদেশফেরত যাত্রী

মির্জা মেহেদী তমাল

টার্গেট বিদেশফেরত যাত্রী

‘বইন কই যাইবা’— স্নেহ-মমতায় মেশানো এমন ডাক শুনে পেছন ঘুরে তাকান রুবিনা। সৌদি আরবপ্রবাসী নারী শ্রমিক রুবিনা একটু আগেই বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন। তার মাথায় একমাত্র শিশু সন্তানের চিন্তা। বাড়িতে খুব অসুস্থ। অপারেশন করাতে হবে। যে কারণে দুই মাস আগেই দেশে ফেরা তার। বিমানবন্দরের পার্কিং এরিয়ায় ঢুকতেই বইন বলে তাকে ডাকছিল এক লোক। অপরিচিত। সেই লোকটি নিজেকে তাজুল নামে পরিচয় দেয়। তার প্রশ্নের জবাবে রুবিনা জানান, তিনি যাবেন জয়পুরহাট। জয়পুরহাট শুনেই তাজুল বলেন, ‘আরে কও কি বইন! আমার বাড়ি দিনাজপুরের হিলি! আমিও ওই দিক যামু।’

রুবিনা তাকে বিমানবন্দরে আসার কারণ জানতে চাইলে তাজুল বলেন, ‘একমাত্র বইনকে এট্টু আগে দুবাইতে পাঠাইয়া দিলাম। পরানডা ছিঁড়া যাইতাছে বইন।’

কাছাকাছি এলাকার অপরিচিত তাজুলকে পেয়ে রুবিনা মনে জোর পান। একসঙ্গে বাসে উঠে গাবতলীর উদ্দেশে রওনা হন তারা। পথে নিজেদের মধ্যে অনেক সুঃখ-দুখের গল্পও করেন। ফার্মগেটে বাস থামলে ক্ষুধা লাগায় রুবিনাকে পানি-পাউরুটি কিনে দেন তাজুল। একপর্যায়ে বোতলে মুখ দিয়ে পানি খেতে গিয়ে একটু পানি রুবিনার গাল বেয়ে পড়ে। ‘ভাই’ তাজুল নিজের রুমাল বের করে সযত্নে পানি মুছে দেন। এ সময় রুবিনা বুঝতে পারেন, রুমালের ছোঁয়ায় তার সেন্স কমে আসছে, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ওদিকে ‘ভাই’ তাজুল তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে সব টাকা নিজের পকেটে ঢোকাচ্ছেন। রুবিনা চেয়ে চেয়ে দেখলেও তা প্রতিরোধ বা বলার মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না তিনি।

অল্প সময়ের মধ্যেই রুবিনার টাকা ও মোবাইল ফোনসহ দামি জিনিসপত্র নিয়ে রুবিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বাস থেকে নেমে চম্পট দেন তাজুল। এর মিনিট পাঁচেক পর রুবিনা স্বাভাবিক হলেও সে সময় কান্না ছাড়া কোনো গতি ছিল না তার।

সচেতনতার অভাবে সন্তানের হার্নিয়ার অপারেশন করাতে আনা সব টাকা উধাও। বাস ভাড়া দেওয়ার টাকাও নেই তখন রুবিনার। পাশের এক যাত্রী ১০০ টাকা দিয়ে তাকে সাহায্য করেন।

এভাবে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হলেও থেমে থাকেননি রুবিনা। বাস থেকে নেমে সৌদি আরবে তার সহকর্মী শম্পার সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকায় তার বাসায় গিয়ে ওঠেন। এরপর টানা তিন দিন বিমানবন্দর এলাকায় গিয়ে চিরুনি অভিযান চালান তিনি। শেষ পর্যন্ত দুই দিন পর সফল হন রুবিনা।

ঠিক একই জায়গায় দেখতে পান তাজুলকে। আরেক বিদেশফেরত পুরুষ যাত্রীকে বলছিলেন, ‘একটু আগে ছোট ভাইটারে বিদেশ পাঠাইলাম, পরানডা..’। এ সময় প্রতারক তাজুলকে পাকড়াও করে ও উত্তমমধ্যম দিয়ে এপিবিএনের কাছে সোপর্দ করেন তিনি। পরে খোয়া যাওয়া টাকা উদ্ধার করে জয়পুরহাটে ফিরে যান রুবিনা। আর বিমানবন্দরে দায়িত্বরত ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ‘ভাই’ তাজুলকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়ে পাঠানো হয় কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে।

প্রতারক তাজুল দীর্ঘদিন ধরে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের নানান কৌশলে অচেতন করে সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়ার কাজ করে আসছিলেন বলে পুলিশ জানায়। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, নানাভাবে বিদেশফেরত যাত্রীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আসা অনেকের স্বজন বিমানবন্দরে আসেন না, তারা একা বাড়ি ফেরেন। এ ধরনের যাত্রীদের টার্গেট করে প্রতারকরা। অনেক সময় সেই প্রতারক নিজেকেও বিদেশফেরত যাত্রী পরিচয় দিয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফেরার কথা বলে যাত্রীদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে। কথা বলতে বলতে সে বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করার নামে টাকা নেয়। কোনো যাত্রীর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা দেখতে পেলে সে তা নিরাপদে রাখার নাম করে আসল মুদ্রা সরিয়ে জাল মুদ্রা দিয়ে প্রতারণা করে। সম্প্রতি মফিজ নামে এক প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়। ২৮ জুন দাম্মাম থেকে আসা চম্পা আক্তার নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা সে হাতিয়ে নেয়। ১৭ জুলাই মালয়েশিয়া থেকে আসা মোসলেম উদ্দিন নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে ১ হাজার ২৫০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত নেয় সে। ওমান থেকে আসা তাহাজ্জুত মিয়া নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সময় গ্রেফতার হয় প্রতারক মফিজ।

সর্বশেষ খবর