বুধবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বে-টার্মিনাল নির্মাণে সিঙ্গাপুর

টেক্কা চীন ভারতকে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের ১৮ হাজার কোটি টাকার বে-টার্মিনাল নির্মাণ ও তার অপারেশনাল কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে শক্তিশালী চীন ও ভারতকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গেছে সিঙ্গাপুরের একটি কোম্পানি। দেশটির রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি (পিএসএ) প্রস্তাবিত টার্মিনাল নির্মাণ ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদে এটি পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কোম্পানিটি জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) যদি জমির মালিক হয় তবে তারা দীর্ঘমেয়াদে টার্মিনাল অপারেশনের চুক্তিতে যেতে আগ্রহী। আর চবক যদি জমির মালিক ও টার্মিনাল অপারেটর হয় তবে তারা জয়েন্টভেঞ্চারে অপারেশনের কাজটি করতে আগ্রহী। সূত্র জানায়, সম্প্রতি কোম্পানিটির একটি টিম ঢাকায় এসে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে তাদের প্রস্তাবনা নিয়ে একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করে গেছে, যেখানে বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও অপারেশনাল কার্যক্রম বিষয়ে সুপরিকল্পিত দিক নির্দেশনা ছিল। উপরন্তু প্রকল্পটি নির্মাণের পাশাপাশি এটি নির্মাণে যে ব্যয় হবে সেই অর্থ ‘সহজ শর্তের ঋণ’ হিসেবে সংগ্রহ এবং তা দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধের সুযোগের বিষয়েও নিশ্চয়তা দিয়েছে পিএসএ। আর এই বিষয়টিই চীন ও ভারতের কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের চেয়ে সিঙ্গাপুরের কোম্পানিটিকে এগিয়ে রাখছে।

কর্মকর্তারা জানান, চীন-ভারতসহ আরও যে দেশগুলোর আগ্রহ রয়েছে প্রকল্পটিতে তারা কেউ টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায়, কেউ আবার শুধু পরিচালনায় আগ্রহী। সিঙ্গাপুরের কোম্পানিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিচালন ও অর্থায়নের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিয়েছে। তবে এই বৃহৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শেষ পর্যন্ত ‘কার ভাগ্যে ছিকে ছিঁড়বে’ সেই সিদ্ধান্ত আসবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।  জানতে চাইলে, নৌপরিবহন সচিব মো. আবদুস সামাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বে-টার্মিনাল নির্মাণে বেশ কয়েকটি দেশের কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করে আমাদের কাছে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে, এখন এসব প্রস্তাবনা নিয়ে একটি সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে পাওয়া দিকনির্দেশনা অনুসারেই বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়ে চুক্তি হবে।

আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তি করার বিষয়ে সরকারের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে নৌসচিব বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে তিনটি টার্মিনালে একসঙ্গে ১৩টি জেটিতে ১৩টি বড় আকারের জাহাজ কনটেইনার লোড-আনলোড করতে পারবে। এর ফলে চবক’র সক্ষমতা অনেকাংশে বেড়ে যাবে।

জানা গেছে, এরই মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণের সমীক্ষা শেষ হয়েছে। একটি মাস্টারপ্ল্যানও পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী প্রকল্পটিতে মোট তিনটি টার্মিনাল হবে। একটি ১ হাজার ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, আরেকটি ১ হাজার ২২৫ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল ও অন্যটি ৮৩০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল-২। সূত্রগুলো জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্প নির্মাণে আরও যেসব দেশের কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে চীন ও ভারত ছাড়াও কোরিয়া এবং আরব আমিরাতের কোম্পানিও রয়েছে। গতবছরের মে মাসে চীনের চায়না মার্চেন্টস স্পোর্ট হোল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড জিটুজি পদ্ধতিতে বে-টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি দেয়। পরে তারা বিওটি (বিল্ট অওন ট্রান্সফার) পদ্ধতিতেও প্রকল্প নির্মাণ এবং ৫০ বছরের কনসেশন চুক্তি সম্পন্ন করার আগ্রহ প্রকাশ করে। তাদের প্রস্তাবনায় প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ধরা হয়েছে ৩-৪ বছর। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ বিলিয়ন ডলার। চায়নিজ কোম্পানিটি টার্মিনাল-১, ২ এবং মাল্টিপারপাস সুবিধা নির্মাণে সম্মত থাকলেও ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের কাজ চবককে করতে হবে। কোরিয়া সরকারের মিনিস্ট্রি অব ফিশারিজ ও ওশানোগ্রাফির অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন পূর্ণাঙ্গ টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক কাজ করার বিষয়েও আগ্রহ দেখিয়েছে। এ বিষয়ে তারা একটি প্রি ফিজিবিলিটি স্টাডিও করেছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড তাদের প্রস্তাবে তারা প্রকল্পটি বিওটি অর্থাৎ বিল্ট অওন ট্রান্সফার পদ্ধতিতে নির্মাণ করতে ইচ্ছুক বলে জানিয়েছে। অথবা সরকার চাইলে তারা বে-টার্মিনাল অপারেট করতেও আগ্রহী বলে প্রস্তাবে জানিয়েছে ডিপি ওয়ার্ল্ড। গত আগস্টে ভারতীয় কোম্পানি এপিএম টার্মিনালস (ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড) প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) কাছে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে সই করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা স্কট রবসন। সূত্র জানায়, ভারতীয় কোম্পানিটি প্রস্তাবনায় বলেছে, বিল্ট অওন ট্রান্সফার (বিওটি) পদ্ধতিতে তারা বে-টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায়। প্রাথমিকভাবে তারা শুধু নির্মাণের সঙ্গেই সম্পৃক্ত থাকতে চায়। নির্মাণ শেষ হলে টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে। কোম্পানিটির কাছে বে-টার্মিনাল নির্মাণে আনুমানিক ব্যয় সম্পর্কেও জানতে চেয়েছিল চবক। জবাবে এপিএম জানিয়েছে, এই মুহূর্তে তারা বাংলাদেশের এই প্রকল্পের ব্যয় সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিতে পারবে না। তবে তারা মনে করছে প্রথম টার্মিনাল নির্মাণে ৩০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ২য় টার্মিনাল নির্মাণে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার এবং ৩য় টার্মিনাল নির্মাণে ২০০ থেকে ৫০০ মিলিয়নের মতো ব্যয় হতে পারে। মূল অবকাঠামো নির্মাণে ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগতে পারে বলেও জানায় ভারতীয় কোম্পানিটি। ভারতের এই প্রস্তাবনার পরপরই সিঙ্গাপুরের পিএসএ’র টিম ঢাকায় এসে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করে যায়।

সর্বশেষ খবর