আমি চোখ খোলার চেষ্টা করি। কিন্তু পারছি না। জোর করে তাকালাম। একি! কিছুই দেখতে পারছি না? আমি কি অন্ধ হয়ে গেলাম! অন্ধকার কেন! চোখ বন্ধ করি। হাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করি। কিন্তু হাতে শক্তি পাচ্ছি না। দুই হাত বাঁধা। দুই পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। পা সোজা করতে চাই। পারি না। মাথা ঘোরাতে গিয়েও পারছি না। আমার বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু পারছি না কেন? মুখ আমার বাঁধা কেন! চারদিকে প্রচণ্ড শব্দ। ঝাঁকুনি। হঠাৎ শব্দও বন্ধ! মানুষের কথা শুনতে পাই। আমি তখন প্রচণ্ড শক্তিতে হাতের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করি। পারি না। কোনো মতে দুই হাত মুখের সামনে এনে স্কচটেপ খুলে ফেলি। মুখ থেকে শব্দ বেরোচ্ছে আমার। এমন সময় একটু আলোর মতো দেখতে পেলাম। একজন মহিলা আর পুরুষের কণ্ঠ। একটু ফুটোয় চোখ রাখি। দেখতে পেলাম তাদের। আমি কি মরিনি! না মরিনি। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে লাগলাম। আমার চিৎকার শুনে ওই মহিলা সামনে ঝুঁকে দেখল। পুরুষটাকে বলছেন, এই কীসের শব্দ এখানে! পুরুষটা বললেন, তাই তো। এখানে এই বড় ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করল মনে হচ্ছে! পরক্ষণেই পুরুষ লোকটি বলে উঠে, আরে না না, ভুল শুনছি। এটা বাসের মালামাল রাখার জায়গা। যাত্রীদের ব্যাগ থাকে। ভিতর থেকে মেয়েলি কণ্ঠ কোথা থেকে আসবে? দেন আপা আপনার ব্যাগটা। ভিতরে রাখি। আবারও সেই মেয়ের কণ্ঠের আকুতি। ঘাবড়ে যায় এবার লোকটা। মহিলাও শব্দ শুনে পুরুষের দিকে তাকান। লোকটা মহিলা যাত্রীকে বলেন, আপনি যান আপা। সিটে যাইয়া বসেন। এ কথা বলেই মাল রাখার ফাঁকা স্থানের ঢাকনা লাগিয়ে দেয়। লোকটা ভয়ে ভয়ে বাসে ওঠে। বাস চলতে থাকে। কিন্তু সেই মহিলা যাত্রী, বাসে উঠেই মেয়ের কণ্ঠ পাওয়ার কথা জানান যাত্রীদের। যাত্রীরা শুনে বাস চালককে বাস থামাতে বলে। বাস থামে। এ সময় সবাই নিচে নেমে মালামাল রাখার ফাঁকা জায়গা দেখতে চায়। সবাই যখন বাস থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখন দুই যুবক বাসের জানালা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে। সন্দেহ হয় যাত্রীদের। তারা পাকড়াও করে দুজনকে। যাত্রীরা দ্রুত নামে, বাসের নিচের ডালা খুলে বড় ট্রাঙ্কটি বের করে তালা ভাঙে। ডালা খুলতেই সবার চোখ কপালে। হতবাক। স্কুল ড্রেস পরা একটা মেয়ে। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। নড়াচড়া করছে। তাকাতে পারছিল না। যাত্রীরা মেয়েটিকে উদ্ধার করে। ওই দুই যুবককে পুলিশের কাছে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ঠিক এভাবেই ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ময়মনসিংহগামী বাস থেকে উদ্ধার করা হয় দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে বাক্সবন্দী অবস্থায় ছিল কিশোরী মেয়েটি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আর কিছু সময় গেলেই হয়তো বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পায় মেয়েটি। ভালুকার একটি স্কুলের শিক্ষক দম্পতির একমাত্র মেয়েকে দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল। বাক্সবন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধারের পর সেই মেয়েটি সব কিছু জানিয়েছে পুলিশের কাছে। গ্রেফতার হওয়া দুই যুবক স্বীকার করেছে তাদের অপরাধের কথা।
দুই যুবকের নাম মনির হোসেন ও মোর্শেদ আলম। এরা আপন দুই ভাই। ভালুকার একটি স্কুল শিক্ষক দম্পতির কিশোরী মেয়েটিকে দিনের আলোয় বাসার ভিতর থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ ও গোয়েন্দারা জানিয়েছে, দ্রুত বড়লোক হওয়ার জন্য তারা মেয়েটিকে অপহরণ করে। মুক্তিপণ আদায় করতেই তারা এই দুর্ধর্ষ কাণ্ডটি ঘটায়। এরা ছিল গার্মেন্ট কর্মী। তাদের বাসা ওই শিক্ষকের বাসার পাশেই।
সেদিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যান ভালুকার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক আরিফুল (ছদ্মনাম)। একটু পর বের হন তার স্ত্রী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা মমতাজ বেগম (ছদ্মনাম)। তাদের একমাত্র মেয়ে সিমি (ছদ্মনাম) বেরিয়ে যায় স্কুলে। বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে দুই ভাই মনির আর মোর্শেদ সব কিছু দেখছিল। বাসায় তখন একা কাজের বুয়া। এই সুযোগে দুই ভাই ঢুকে পড়ে সেই বাসায়। তাদের কাছে বড় একটা ট্রাঙ্ক। দরজায় কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে বুয়া খুলে দেয় দরজা। দুই যুবককে চেনে বুয়া। দুই ভাই বুয়াকে জানায়, ট্রাঙ্ক নিয়ে আসতে বলছিলেন স্যার। ভিতরে রাখতে বলেছে এটা। বুয়া সরল বিশ্বাসে তাদের ভিতরে ঢুকতে দেয়। দুই ভাই ভিতরে ঢুকেই আক্রমণ করে বুয়াকে। চেতনানাশক কেমিক্যাল বুয়ার নাকে ধরে। জ্ঞান হারায় বুয়া। হাত-পা বেঁধে বেডরুমে ফেলে রাখে তাকে। এরপর বাসার ভিতর ঘাপটি মেরে থাকে তারা। ঘণ্টাখানেক পর সিমি স্কুল থেকে বাসায় ফিরে। কলিংবেল বাজায়। দরজা খুলে দেয় মোর্শেদ। সিমি তাদের দেখেই পরিচয় জানতে চায়। তারা ট্রাঙ্ক নিয়ে এসেছে জানায়। তার বাবার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে তারা। এ কথা শুনে ভিতরে ঢুকে সিমি। বুয়াকে ডাক দেয় সিমি। বেডরুমে গিয়েই দেখতে পায় পড়ে আছে বুয়া। মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। সিমি চিৎকার দেয়। পেছনেই দাঁড়ানো সেই দুই ভাই। সিমিকে জাপটে ধরে ফেলে। নাকে লাগিয়ে দেয় চেতনানাশক কেমিক্যাল। জ্ঞান হারায় সিমি। পরে তারা সিমিকে হাত-পা মুখ বেঁধে ট্রাঙ্কে ভরে। দুই ভাই মিলে সেই ট্রাঙ্ক ধরাধরি করে নিয়ে যায় রাস্তায়। ঢাকা ময়মনসিংহ রোডে নিয়ে দাঁড়ায়। শেরপুরগামী বাসে তারা সিগন্যাল দিয়ে বাসে চড়ে বসে। আর ট্রাঙ্ক তোলা হয় বাসের নিচে থাকা মাল রাখার স্থানে। বাস চলার একপর্যায়ে একটা ব্রিজের সামনে থেকে এক মহিলা যাত্রী ওঠেন বাসে। তার লাগেজ বাসের সেই ফাঁকা স্থানে রাখতে গিয়েই সন্ধান মেলে বাক্সবন্দী কিশোরীর।পুলিশ জানতে পেরেছে, এই দুই ভাই শিক্ষকের বাড়ির ভিতরের একটা ঘরে ভাড়া থাকত। শিক্ষক তার নিজের বাড়িটা বিক্রি করে দেয়। এ বিষয়টা জানত দুই ভাই। ওই শিক্ষক তাদের বিশ্বাস করতেন খুব। তাদের সামনেই বেশ কয়েকবার আলাপ-আলোচনা করেছেন বাড়ি বিক্রি করার বিষয়ে। যে কারণে দুই ভাইকে নোটিস দেওয়া হয়। তারা শিক্ষকের বাসার পাশেই অন্য একটি রুম ভাড়া নেয়। বড় ভাই স্থানীয় বখাটে ছেলেদের সঙ্গে চলাফেরা করত আগে থেকেই। শিক্ষকের বাড়ি বিক্রির টাকার লোভে পড়ে সে। তারা শিক্ষকের বাসায় দীর্ঘদিন ধরে থাকার কারণে শিক্ষকের বাড়ির সব কিছুই জানত। কে কখন বাইরে যায়, কখন আসে, সব কিছুই তাদের মুখস্থ ছিল। যে কারণে অপহরণ তারা সঠিকভাবেই করতে পেরেছিল। কিন্তু রাস্তায় ধরা পড়ে। এই দুই ভাইয়ের বাড়ি শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে।
পুলিশ জানায়, সরল বিশ্বাসে এমন অপরিচিত দুই ভাইকে বাসায় ভাড়া দেওয়াটা ছিল শিক্ষকের ভুল। এ ছাড়া বাইরের লোকদের সামনে বাড়ি বিক্রি আর বিক্রির টাকার বিষয় আলোচনা করাটাও ছিল বোকামি। ছোট ভুলের কারণে বড় ধরনের একটি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছিল শিক্ষক পরিবারের। যে ক্ষতি আর হয়তো পূরণ করাও সম্ভব হতো না।