শিরোনাম
রবিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

জামানতবিহীন ঋণের ফাঁদে ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক

জামানতবিহীন ঋণের ফাঁদে ব্যাংক

জামানতবিহীন ঋণ এখন দেশের ব্যাংকিং খাতের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। নামমাত্র জামানতের বিপরীতে দেওয়া বৃহদাকার ঋণগুলোর বেশিরভাগই আদায় করতে পারছে না ব্যাংক। ব্যাংক খাতে দুর্বল জামানত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এই ঋণ এখন খেলাপি হতে চলেছে। তাই ব্যাংকগুলো জামানতবিহীন ঋণের ফাঁদ থেকে বেরুতে পারছে না। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশের ব্যাংকিং খাতের সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের জন্য বড় ধরনের হুমকি।   আর জামানতবিহীন বা নামমাত্র জামানত নিয়ে যেসব বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই খেলাপি হওয়ার পথে। এটা ব্যাংকিং খাতকে স্মরণকালের ভয়াবহতম সংকটের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। জানা গেছে, এক ব্যাংকের পরিচালক কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মৌখিক অনুরোধে জামানত না নিয়ে কিংবা নামমাত্র জামানত নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকেরই নাম উঠে এসেছে শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায়।  খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, একশ্রেণির অসাধু গ্রাহক ও ব্যাংকার করপোরেট গ্যারান্টির অপব্যবহার করছেন। করপোরেট গ্যারান্টির বিপরীতে বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচিতি জামানত হিসেবে ব্যবহার করে ঋণ বা নাম পরিচিতি জামানত হিসেবে ব্যবহার করে ঋণ এবং পারসোনাল গ্যারান্টির এগেনেইস্টে লেন্ডিং বা ব্যক্তি পরিচিতি জামানত হিসেবে ব্যবহার করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া জামানতবিহীন এসব ঋণ ছাড়ে কিছু অসাধু ব্যাংকার গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশ করে কমিশন নিয়ে তা দ্রুত ছাড় করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ ধরনের ঋণ আগে বেসরকারি ব্যাংকে সীমিত থাকলেও সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। বেসরকারি এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালককে ঋণ দিতে প্রভাবিত করছেন। এতে কোনো ধরনের জামানতই নেওয়া হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামান্য কিছু জামানত দিয়ে মোটা অঙ্কের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এমন কি সেসব ক্ষেত্রেও দেওয়া জমিজমার দলিলাদি ভুয়া প্রমাণিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। জামানতবিহীন এসব ঋণের বেশিরভাগই আদায় করা সম্ভব হয় না। পরবর্তীতে তা খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে করপোরেট গ্যারান্টির বিপরীতে (ফান্ডেড-নন ফান্ডেড) ঋণ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এই ঋণের কত শতাংশ আদায় করা সম্ভব হবে তা জানে না সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। করপোরেট গ্যারান্টির বিপরীতে দেওয়া ঋণ এবং জামানতবিহীন ঋণের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এ ফর্মুলা চালু রয়েছে। তবে সেসব দেশে এ ফর্মুলার অব্যবহার হয় না। আর বাংলাদেশে এর অপব্যবহারই বেশি হচ্ছে। যার অন্যতম কারণ হচ্ছে নৈতিকতার স্খলন। অসৎ ব্যাংক গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তারাই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, করপোরেট গ্যারান্টির বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসরকারি খাতের ছয় থেকে আটটি ব্যাংকই দিয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার ঋণ। আড়াই লাখ কোটি টাকার বাকি অংশ গেছে অন্য ব্যাংকগুলো থেকে। শুধু তাই নয়, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই দিয়েছে করপোরেট গ্যারান্টি, যা নামমাত্র জামানতে ঋণ দিয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। আর অন্য দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও তিনটি পুরনো বৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক এ ধরনের ঋণ দিয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা। যা এখন পুরো ব্যাংক খাতকে সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ চট্টগ্রামভিত্তিক একটি কোম্পানির। যা দেশের ১৩টি ব্যাংকে ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত। সে প্রতিষ্ঠানটিকেই জামানতবিহীন ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিয়েছে ৩ লাখ ১১ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। এই ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই দেওয়া হয়েছে কোনো রকম জামানত ছাড়া। এ ঋণের অন্তত আরও ১৫ শতাংশ দেওয়া হয় নামমাত্র জামানতের বিপরীতে। যা আদায় করা সম্ভব হবে না। ফলে কোনো এক সময় এসব ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জামানতবিহীন ঋণের ধারণাটিই একটি ভ্রান্ত ধারণা। যার মাধ্যমে ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়। এ অবস্থা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে না পারলে ব্যাংক খাত গভীর সংকটে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

সর্বশেষ খবর