সোমবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

অজ্ঞান পার্টির ডাবের পানি

মির্জা মেহেদী তমাল

অজ্ঞান পার্টির ডাবের পানি

বায়তুল মোকাররম এলাকায় ডাব খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েন ঢাকা জেলা জজ কোর্টের একজন আইনজীবী। তাকে অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। জুরাইন থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে বনশ্রীর অফিসে যাচ্ছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শফিকুল আলম। জুরাইনে তিনি একটি ডাব কিনে খান। এরপর বাসে চড়ে বসার পর তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। তাকে আবদুল্লাহপুর থেকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত মাসে ফার্মগেট এলাকায় এক সঙ্গে অচেতন হয়ে পড়েন পাঁচজন। এভাবে প্রতিনিয়ত অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা শিকার ধরার ভয়ংকর ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে ডাবের পানি। ডাব বিক্রেতাদের কারও কারও সঙ্গে আঁতাত করে এ চক্র সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে। টার্গেট ব্যক্তিকে ডাবের সঙ্গে অচেতন করার ওষুধ খাইয়ে দেয় কৌশলে। এরপর ওই ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়লে কেড়ে নেয় তার সর্বস্ব। রাজধানীতে প্রতিনিয়ত এ পার্টির এমন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন মানুষ। এদের খপ্পর থেকে রেহাই পাচ্ছেন না আইনজীবী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। চলতি বছরে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে সহস াধিক মানুষ। অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ২০১০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এর মধ্যে ঢামেকে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় আট হাজার মানুষ। আর মিটফোর্ড হাসপাতালে দুই হাজারেরও বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন আরও অনেকেই। প্রতিদিনই এ পার্টির কবলে পড়া লোকজন হাসপাতালে ভর্তি হলেও তারা সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যান। অভিযোগ জানাতে থানায় বা পুলিশের কাছে যান না। ফলে এ চক্রের কবলে পড়া লোকজনের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। ঢামেক হাসপাতালে আসা রোগীদের অচেতন হওয়ার কারণ পর্যালোচনা করে জানা গেছে, তাদের অধিকাংশই অচেতন হওয়ার আগে রাজধানীর কোনো না কোনো পয়েন্টে ভাসমান বিক্রেতাদের কাছ থেকে ডাব কিনে খেয়েছেন। আর ডাবের পানি পান করার পরই তারা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ চক্রের সদস্যরা রাজধানীর কিছু কিছু এলাকা টার্গেট করে। তবে ব্যস্ততম এলাকাকে তারা বেছে নেয়। যাতে কেউ কারও খবর না রাখে। চক্রটি ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমে ডাবে নেশাজাতীয় ওষুধ পুশ করে। পরে ওই ছিদ্রস্থান আঠাজাতীয় বা সুপার গ্লুু দিয়ে বন্ধ করে দেয়। তাতে বোঝার কোনো উপায় থাকে না ডাবের মধ্যে নেশাজাতীয় কিছু মেশানো আছে। এরপর চক্রটির টার্গেট করা ব্যক্তির কাছে অপেক্ষাকৃত কম দামে ডাবটি বিক্রি করে। আর ক্রেতা কখনো কখনো এ ডাবের পানি পান করার কিছুক্ষণ পর রাস্তায় পড়ে যান। এ সময় অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাকে সহযোগিতার নামে অন্যত্র সরিয়ে নেয়। তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। আবার ডাব ক্রেতা পানি পান করার পর কোনো গাড়িতে উঠে বসলে এ চক্রের সদস্যরা তার পিছু নেয়। পরে তিনি অচেতন হয়ে পড়লে সর্বস্ব লুটে নিয়ে তারা নেমে পড়ে। ডাব খেয়ে অসুস্থ হলেও সুস্থ হয়ে কেউ আর ওই ডাব বিক্রেতার সন্ধান করতে যাননি। এমনকি তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্মরণাপন্নও হননি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বেশ কয়েকটি থানার পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়ালেও কেউ অভিযোগ নিয়ে থানায় আসেন না। থানায় এলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। অভিযুক্ত ডাব বিক্রেতাকে আটক করলেই চক্রের সন্ধান করা যেত। তবে ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনরা বলছেন অন্যকথা। তারা বলছেন, পুলিশি ঝামেলা এড়াতে তারা থানা পুলিশের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন না। এ ছাড়া ওই চক্রের শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর কোনো রোগীরই আর থানায় গিয়ে অভিযোগ করার মতো মানসিকতা থাকে না। আর বিশ্লেষকরা বলেছেন, পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের এখনো শতভাগ আস্থা সৃষ্টি হয়নি। মানুষ এখনো কোনো জরুরি প্রয়োজনে পুলিশের কাছে যেতে ভয় পান। তারা বলছেন, অজ্ঞান পার্টি দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বউদ্যোগেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। অজ্ঞান পার্টির প্রতারণার শিকার হয়ে অধিকাংশ মানুষ ঢামেক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সরকারি হাসপাতালগুলোতেই ভর্তি হন। এসব হাসপাতালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত ডিউটি করছেন। বিভিন্ন সংস্থার লোকজন হাসপাতালে আসা রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর সংশ্লিষ্ট থানায়ও এ বিষয়ে অবহিত করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনী ইচ্ছা থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর কাছ থেকে স্বউদ্যোগে তথ্য নিয়ে অভিযান চালাতে পারে। শুধু ডাবেই নয়, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা কখনো আচারের সঙ্গে, আবার কখনো বিভিন্ন হারবাল হালুয়ার সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে শিকার ধরে। এ চক্রের সদস্যরা রাজধানীর রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল, বড় বড় শপিংমলের আশপাশ— এমনকি ব্যস্ত রাস্তার পাশে ছদ্মবেশে সক্রিয়। এ ছাড়াও যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, রামপুরা, বনানী, আরামবাগ, মগবাজার, ফার্মগেট, আসাদগেট, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, ফকিরাপুল বাজার, দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল, মিরপুরে বেশি তৎপর। অর্ধশতাধিক গ্রুপে এ পার্টির সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপে পাঁচ থেকে ছয়জন করে সদস্য রয়েছে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন পরিবহনের হেলপার ও সুপারভাইজারদের আঁতাত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে এ বিড়ম্বনা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব বলে পুুলিশ জানিয়েছে। তাদের পরামর্শ হলো, ভ্রমণ পথে অযাচিতভাবে অপরিচিত কেউ অহেতুক ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলে তাকে পাত্তা দিবেন না। আজকাল ডাবের ভিতরে সিরিঞ্জের মাধ্যমে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে থাকতে পারে। তাই কখন কোথা হতে তৃষ্ণা মিটাচ্ছেন সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারও হাতে রুমাল দেখলে সতর্ক থাকুন। কারণ রুমালের মধ্যে ক্লোরোফর্ম মিশিয়ে আপনার নাকের কাছে ধরলেই আপনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। ফুটপাথে বা রাস্তার মোড়ে টং দোকান থেকে খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন। ফেরিওয়ালা বা ভ্রাম্যমাণ কারও কাছ থেকে আচার, আমড়া, শসা, পেয়ারা প্রভৃতি খাবেন না।

সর্বশেষ খবর