মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কোটি টাকার এসএমএস

মির্জা মেহেদী তমাল

কোটি টাকার এসএমএস

উত্তরার বাসিন্দা আবুল আজাদ সোলাইমানের মোবাইলে একটি মেইল আসে। মেইলে লেখা ছিল, ‘যুক্তরাজ্যের কোকাকোলা কোম্পানির লটারিতে আপনার মোবাইল নম্বরটি ৮ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড জিতেছে। পুরস্কারের অর্থ গ্রহণের জন্য আপনার ও বাবা-মার নাম, জন্ম তারিখ, মোবাইল নম্বর উল্লিখিত ইমেইলে পাঠান। [email protected] থেকে মেইল পেয়ে আজাদ ভাবছেন, কী করবেন তিনি। এত টাকা একসঙ্গে পাবেন! জীবনটাই পাল্টে যাবে তার। তিনি সবকিছু পাল্টা মেইলে পাঠিয়ে দেন। ভাবতেও পারেননি, তিনি ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে মোটা অঙ্কের টাকা খোয়াবেন। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব মেইল সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা ও প্রহসনমূলক। এ ধরনের মেইলের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছ থেকে কিছু ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হয়। সেসব তথ্য নিয়ে প্রতারকরা নানা ধরনের ব্যবসা করে। অনেক সময় গ্রাহককে ব্ল্যাকমেইল করে তার কাছ থেকে অর্থও হাতিয়ে নেয়। এসএমএস আসে বিভিন্ন ধরনের। নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের টাকা মুক্তহস্তে দানের এসএমএস অনেকেই পায়। এসব এসএমএসের মাধ্যমেও গ্রাহকের নাম, বাবা-মায়ের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর ও জন্ম তারিখ চাওয়া হয়। টাকার লোভে অনেকেই ফিরতি এসএমএস পাঠায়। ভয়াবহ সত্য হলো, এসব তথ্য দিয়ে যে কেউ চাইলে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খালি করে দিতে পারে। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার ও সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস নিয়ে ওয়াহেদুল দীপু কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের এসএমএসকে স্প্যাম বলা হয়। এসএমএস পাঠিয়ে প্রতারকরা গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিয়ে অপরাধ করে। এ ছাড়া গ্রাহকদের তথ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রিও করে তারা।’ তিনি বলেন, ‘একদল প্রতারক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অথবা র‌্যান্ডমলি কিছু নম্বর সংগ্রহ করে এ ধরনের লটারি জেতার ভুয়া এসএমএস পাঠায়। যেসব গ্রাহক তাদের ফিরতি এসএমএস পাঠায় তাদের তথ্যগুলো সংগ্রহ করে প্রতারকরা বিভিন্ন টেলিমার্কেটিং প্রতিষ্ঠানসহ নানা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। প্রতিষ্ঠানগুলো সচল গ্রাহকদের নাম, ফোন নম্বর ও ইমেইল সংগ্রহ করে তাদের বিজ্ঞাপনের এসএমএস পাঠায়। এসব এসএমএসের একটি ভয়াবহ দিক হচ্ছে, আমরা অনেক সময় তাদের সঙ্গে এমন কিছু তথ্য শেয়ার করি যেগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভেরিফিকেশনের সময় প্রয়োজন হয়। যেমন মায়ের নাম, জন্ম তারিখ। কথিত লটারিতে জেতা টাকার চেক প্রদানের জন্য অনেক সময় প্রতারকরা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের নম্বর চায়। তাদের এসব তথ্য দিলে যে কোনো সময় কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে গ্রাহকের টাকা নিজেদের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেও নিতে পারে।’ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট জানায়, এ ধরনের প্রতারক চক্রের সবাই বাংলাদেশে অবস্থানরত আফ্রিকান নাগরিক। তাদের কেউ ফুটবল খেলার নাম করে, কেউ গার্মেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগকারী হিসেবে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে। কাউন্টার টেররিজমের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘১৯৯৮ সালে এ ধরনের অপরাধ শুরু। সে সময় একটি ইমেইলে বলা হয়েছিল, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমার বাবা-মা মারা গেছেন। আমার কিছু সম্পদ ও ব্যাংক ব্যালান্স রয়েছে। সেগুলো বিলিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে বেছে নিয়েছি। টাকা পেতে তোমার নাম, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, দ্বিতীয় মোবাইল নম্বর, বাসার নম্বর, জেলা, ইমেইল, বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, পেশা, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট নম্বর, ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্ক্যানকপি পাঠাতে হবে।” ফিরতি মেইলে তথ্য পাঠানোর পর তারা সেসব তথ্য নিয়ে উল্টো গ্রাহককেই ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। তাদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে টাকা আদায় করে। কয়েকজন গ্রাহক থেকে আমরা ১৫-২০ টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ পেয়েছি।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের অপরাধ সাধারণত বিদেশিরা করে। সঙ্গে বাংলাদেশি কয়েকজনও জড়িত। তারা মূলত নতুন বাজার, কাওলা ও উত্তরা থেকে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে। এখন পর্যন্ত এ চক্রের ৪০ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, সম্প্রতি একজন প্রতারক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। গ্যারান্টারের জায়গায় সে গ্রাহক থেকে সংগৃহীত ছবি, এনআইডি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর ইত্যাদি বসিয়ে দেয়। প্রতারকরা ব্যাংক ঋণ তুলে পালিয়ে যায়। পরে ব্যাংক থেকে ওই ভুক্তভোগীকে ডাকা হলে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তদন্তের পর ভুক্তভোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয় কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো সিআইবি বিভাগের রিপোর্টে তার নাম উঠে আসে। এ কারণে ওই গ্রাহক আর কখনো ব্যাংক ঋণ নিতে পারেননি।’ প্রতারকদের তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ধরন সম্পর্কে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘অনেক সময় এ ধরনের ইমেইলের ছবি কিংবা লেখার পেছনে নানা ধরনের লিঙ্ক লুকিয়ে রাখা হয়। এসব লিঙ্কে ক্লিক করলে বুঝবেন আপনি আপনার ইমেইল অ্যাকাউন্টের অ্যাক্সেস বা অনুমতি তাকে দিয়ে দিয়েছেন। পরে প্রতারকরা সেই অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে নানা ধরনের অপরাধ করে। অনেক সময় অ্যাকাউন্ট ফিরিয়ে দিতে মোটা অঙ্কের অর্থও দাবি করে।’ ‘এ ধরনের ভুয়া এসএমএস ও ইমেইল এড়িয়ে যাওয়াই ভালো’— মত দেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর