শনিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

হ্যালো, আপনার ছেলে সমস্যায়

মির্জা মেহেদী তমাল

হ্যালো, আপনার ছেলে সমস্যায়

‘হ্যালো, আমি এয়ারপোর্ট থেকে বলছি। আপনার ছেলে সমস্যায় পড়েছে। ফ্লাইটে উঠতে পারছে না। কাগজপত্রে ঝামেলা আছে। সমাধান করতে হলে টাকা লাগবে। দ্রুত এই নম্বরে বিকাশ করে ৩০ হাজার টাকা পাঠান।’ বিদেশগামী ছেলেকে বিদায় দিয়ে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই এমন খবরে বিচলিত আকবর আলী। কুমিল্লার আকবর আলীর ছেলে আজম রিয়াদ যাচ্ছিলেন। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে ছেলেকে বিদেশে পাঠাচ্ছিলেন তিনি। শেষ মুহূর্তে এমন খবরে কী করবেন ভাবতে পারছেন না। ফোনের অন্য প্রান্তের ব্যক্তির কাছে ছেলের সঙ্গে কথা বলার আকুতি জানান তিনি। তখন অন্য প্রান্ত থেকে কান্নাজড়িত মৃদুকণ্ঠে একজন বলে, ‘বাবা! প্রবলেম হয়ে গেছে। আমার যাওয়া হবে না। শিগগির টাকা পাঠাও।’

আকবর ছেলের বিপদ শুনে দ্রুত এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিকাশের নির্দিষ্ট নম্বরে টাকা পাঠান। তখন থেকে কল দেওয়া সেই নম্বর ও ছেলে আজমের নম্বর বন্ধ। উৎকণ্ঠায় সময় কাটে স্বজনদের। রিয়াদ থেকে ফোন আসে। বাবা ফোন ধরেন। ছেলে আজমের ফোন। আজম বলছিলেন, ‘বাবা! আমি ঠিকমতো এসেছি।’ ছেলের কণ্ঠ শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন বাবা আকবর। বলেন, ‘বাবা! তুই ঠিকমতো গেছিস? কাগজপত্রে ভুল হলো কেন রে? টাকাটা ঠিকমতো পেয়েছিলি তো বাবা?’ বাবার মুখে এসব কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারেন না আজম। তিনি তার বাবাকে বলেন, ‘বাবা! তুমি কী বলছ? কীসের সমস্যা! আমি তো কোনো সমস্যায় পড়িনি।’ এক বছর আগের এ ঘটনায় আকবর আলী ও তার পরিবারের সদস্যরা জানতেও পারলেন না, কী দিয়ে কী হলো। তারা এটা নিশ্চিত যে, তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তবে এ প্রতারণা কে, কীভাবে করল বুঝতে পারেননি তারা। স্থানীয় থানায় অবশ্য একটি সাধারণ ডায়েরি করে রাখেন আকবর আলী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঠিক এভাবেই বিদেশগামী যাত্রীদের ফোন নম্বর নিয়ে পরিবারের কাছে ফোন দিচ্ছে একটি চক্র। কাগজপত্রের ত্রুটির কথা বলে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। ভুক্তভোগীদের মধ্যে অনেকেই বিমানবন্দরের পুলিশ, সিভিল এভিয়েশন, ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ বিভিন্ন স্থানে মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে প্রতারণার সূত্র খুঁজে পায়নি কেউ। শেষে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা এক মামলার তদন্তে নেমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জেনেছে এর রহস্য। সিআইডিসূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষী জাবেদ (৪০) এই অভিনব প্রতারক চক্রের হোতা। তিনি বিদেশগামী যাত্রীদের তথ্য ফরম পূরণ করার সময় কথা বলে স্বজনদের ফোন নম্বরসহ প্রয়োজনীয় তথ্য নিতেন। ফ্লাইটে ওঠার পর বিদেশগামী যাত্রীর মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ হলেই শুরু হতো জাবেদের ‘প্রবলেম’ প্রতারণা। স্বজনদের ফোন করে সমস্যার কথা বলতেন, এমনকি কণ্ঠ নকল করে কেঁদেও স্বজনদের তা বিশ্বাস করাতেন জাবেদ। সিআইডি কর্মকর্তাদের ধারণা, জাবেদ এ রকম প্রতারণা করে গত তিন বছরে কমপক্ষে ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে বিমানবন্দরের কনকোর্স হলের বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের কর্মী জাবেদ ও দুই বিকাশ এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা তিন বছরে ১ হাজারের বেশি যাত্রীর স্বজনদের ফোন নম্বরে একই কায়দায় সমস্যার কথা বলে প্রতারণা করেছেন। এতে কমপক্ষে ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জাবেদ ও তার সহযোগীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন চক্র এখনো সক্রিয় রয়েছে। বিদেশগামী যাত্রীদের পরিবারের সদস্যদের এ সময় ফোনে বিচলিত না হয়ে বিষয়টি আগে নিজেদের জানার চেষ্টা করতে হবে। অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হবে। তবেই এ ধরনের প্রতারক চক্রের কাছ থেকে নিজেদের দূরে রাখা সম্ভব।

সর্বশেষ খবর