বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ভোটের হাওয়া সারাদেশে

কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে রাজনৈতিক সংস্কারে গুরুত্ব

রুহুল আমিন রাসেল

এবার সংসদ নির্বাচনে ‘ভিশন মুক্তিযুদ্ধ-৭১’ স্লোগান নিয়ে কাস্তে মার্কায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইশতেহার প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। ইশতেহারে বৈষম্যহীন ইনসাফের সমাজ গড়া এবং রুটি-রুজি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারনামা থাকছে। ডিজিটাল আইনসহ অগণতান্ত্রিক সব কালো আইন বাতিল, নির্বাচনব্যবস্থার আমূল সংস্কার, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংবিধান, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও রাজনীতির সংস্কারের কথাও ইশতেহারে আছে বলে জানা গেছে। দেশের পুরনো এই বামপন্থি দলটির ইশতেহারে থাকছে— প্রধানমন্ত্রীর সর্বময় ক্ষমতা কমিয়ে ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণে সাংবিধানিক সংস্কার, রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার-হয়রানি বন্ধ, গুম-খুন-অপহরণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অব্যবস্থাপনা, নৈরাজ্য, ব্যাংক চুরি-লুটপাট বন্ধ ও অযাচিত ঋণ না দেওয়ার কথা। সব মানুষের নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধের কথাও বলবে সিপিবি।

বিজয়ের মাসের প্রথম দিন ১ ডিসেম্বর শনিবার পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ ইশতেহার ঘোষণা করবেন কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। দলটির একঝাঁক বিচক্ষণ নেতা ইশতেহার প্রণয়নে জড়িত। এ প্রসঙ্গে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এবার নির্বাচনে নতুন ভোটার হিসেবে ভোট দিতে তরুণ প্রজন্মর রাজনীতির প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা। রাজনীতির নীতিহীনতার যে নগ্ন রূপ দলবদলের মধ্য দিয়ে দেখতে পাচ্ছি এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে বামপন্থিরা নীতিনিষ্ঠ সংগ্রাম করছেন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের ও অংশগ্রহণকারী সাধারণ জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের অন্যতম কাজ। সিপিবি তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভিশন মুক্তিযুদ্ধ-৭১ বাস্তবায়ন করে দেশকে এগিয়ে নেবে। সূত্র জানান, বৈষম্যহীন ইনসাফের সমাজ গড়ার অঙ্গীকার ও নির্দেশনা থাকছে সিপিবির ইশতেহারে। এতে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার ঘোষণায় যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা দীর্ঘদিন তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই ভিশন মুক্তযুদ্ধ-৭১-এর ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বর্তমান সময়ের সুবিদিত বাস্তবতার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ইশতেহারে বলা হয়েছে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের অন্যতম প্রধান চার বিপদ লুটপাটতন্ত্র, গণতন্ত্রহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবিলা করা হবে। এজন্য চলমান আন্দোলনের পাশাপাশি কাস্তে মার্কা নিয়ে নির্বাচনে শামিল হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। দলটি কাস্তে মার্কায় ভোট দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, সিপিবি ও বাম গণতান্ত্রিক জোট সরকার গঠন করে সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে চার মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক সব বিধিবিধান বাতিল, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও কর্মসংস্থানকে জনগণের মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসেবে গণ্য ও সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হবে। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ইশতেহারে বলা হচ্ছে, উৎপাদনশক্তির বিকাশের স্বার্থে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে ব্যক্তি বা বেসরকারি খাত, সমবায়, রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য খাতকে সহায়তা করা হবে। লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্পকারখানার স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রীয় সহায়তা দেওয়া হবে। দেশের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করার স্বার্থে অনগ্রসর এলাকা এবং প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ আর্থিক বরাদ্দ, প্রকৃত সমতার ভিত্তিতে উন্নয়ন করা হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও শক্তিশালী গণবণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। সর্বত্র ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সরকারি ‘বাফার স্টক’ গড়ে তোলা, বাজার-সিন্ডিকেটের অপরাধী চক্র সমূলে উৎপাটন করা, মজুদদারি কঠোরভাবে দমন করা হবে। নির্বাচন ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে সিপিবি বলেছে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা হিসেবে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করা হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে।

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-দুর্বৃত্তায়ন-মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান; সব বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার, জঙ্গি নেটওয়ার্ক নির্মূল, মাফিয়া-গডফাদারদের দমন এবং অপরাধী চক্রের দেশি-বিদেশি অর্থ ও শক্তির উৎসসমূহ উৎপাটনে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করবে কমিউনিস্ট পার্টি। ঘুষ ছাড়া চাকরি হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে ইশতেহারে বলা হয়, ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হবে। কালো টাকা সাদা করার নীতি পরিহার ও কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করা। চোরাচালানি, কালোবাজারি, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, পেশাদার অপরাধী-খুনি প্রভৃতি সামাজিক অপরাধী চক্রকে কঠোরভাবে দমন করার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে বামপন্থি এ দলটি। ইশতেহারে শ্রমিক ও কর্মচারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নয়ন, বন্ধ কলকারখানা চালু, পাটশিল্পকে রক্ষার জন্য কার্যকর বহুমুখী ব্যবস্থা, গার্মেন্ট শিল্পে ও অন্যান্য কলকারখানায় দুর্ঘটনা রোধ, শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাবিধান, স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ নিশ্চিত ও ফ্যাক্টরি আইন কার্যকরের কথাও থাকছে। থাকছে ১৬ হাজার টাকা জাতীয় নিম্নতম মজুরি নির্ধারণসহ মজুরি কমিশনের সুপারিশসমূহ পুনর্বিন্যস্ত করে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। ইশতেহারে সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন, একই ধারার গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালুর প্রতিশ্রুতিও দেবে দলটি। এতে স্বাস্থ্য খাত ও চিকিৎসার মানোন্নয়ন, সুষম ও অভিন্ন গণমুখী চিকিৎসানীতি, স্বাস্থ্যনীতি ও ওষুধনীতি; পর্যায়ক্রমে সবাইকে সরকারি স্বাস্থ্যবীমার আওতায় নিয়ে আসার কথাও বলবে কমিউনিস্ট পার্টি।

সর্বশেষ খবর