বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
প্রকূতি

শালবন উজাড় খাবার সংকটে হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী

মো. নাসির উদ্দিন, টাঙ্গাইল

শালবন উজাড় খাবার সংকটে হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী

মধুপুর শাল গজারি বন উজাড় হওয়ায় বনে খাবার মিলছে না বানর-হনুমানসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণীর। যেসব গাছের ফলফলারি আর লতা-পাতায় বন্য প্রাণীদের পেট পুরার কথা সেসবের অনুপস্থিতি এ বনে এখন প্রকট। তাই ওরা পেটের তাগিদে বন ছেড়ে যাচ্ছে লোকালয়ে। ক্ষুধা নিবারণে গৃহস্থের ফসল ফল বা সবজি বাগানে হামলে পড়ছে। এতে গৃহস্থরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিষটোপ দিয়ে এদের  বেঘোরে মেরে ফেলছে।

মধুপুর শাল গজারি বন এক সময় গহিন অরণ্যে ছিল ভরপুর। সে সময় বানর-হনুমানসহ বাহারি রঙের নানা প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির ও কলতানে মুখরিত থাকত এ বন। গাছে গাছে পাখিরা গান করত আর নাচত। গাছের ডালে ডালে লাফালাফি করত শত শত বানর, হনুমান ও কাঠবিড়ালি। রাজকীয় গুরুগম্ভীর ভঙ্গিমায় বিচরণ করত বাঘ। ঘুরে বেড়াত বুনোহাতির পাল। বৃষ্টিঝরা রৌদ্রে পেখম মেলা ময়ূর, আর ডাগর নয়না হরিণ ছাড়াও বাঘডাসা, ভাল্লুক, বুনো মহিষ, কাঠবিড়ালি, বনবিড়াল, শূকর, বেজি, শিয়াল, ওয়াফ, সজারু, গুঁইসাপ, অজগরসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী দেখা যেত এ বনের সর্বত্র। ১৯৪৭-৪৮ সালে বন বিভাগের বার্ষিক প্রোগ্রাম রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ওই বছর বন্য শূকর ও বানর এলাকার আশপাশের শত শত একর জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।  ১৯৫০ সালে জমিদারি ও প্রজাস্বত্ব আইনের হোলসেল রিকুইজিশনের মাধ্যমে শালবন সরকারি ব্যবস্থপনায় তথা বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর থেকেই বনের দুর্দশা শুরু হতে থাকে। সেই থেকে বিলুপ্ত হতে থাকে নানা প্রজাতির বন্য প্রাণী।

 নিশ্চিহ্ন হতে থাকে জীববৈচিত্র্য। ১৯৭৭ সালে বেসরকারি উদ্যোগে হোসেন অ্যান্ড হক পরিচালত জরিপ থেকে জানা যায়, এ বনে ১৪০ প্রজাতির পাখি ছিল। তন্মধ্যে ১১৬ প্রকার স্থানীয় এবং ২৪ প্রকার অতিথি পাখি। ১৯৮৬ সালে জার্মান কালচারাল একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘কনজারভেশন অব ওয়াল লাইফ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ২ লাখ ৮৬ হাজার বানর এবং ৩৭ হাজার হনুমান ছিল বলে উল্লেখ রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য অংশই ছিল মধুপুর গড়ের শাল-গজারি বনে। ১৯৮২ সালের যুক্তরাজ্যের কারডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সিটিন্স পরিচালিত জরিপ থেকে এ বনে ২১ প্রকার বন্যপ্রাণীর অস্তিত্বের কথা জানা যায়। ওই জরিপে ৫৪৫ কিলোমিটার আয়তনের শালবনে ১৩ হাজর ২০০ হনুমান ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৮৬ সালের নভেম্বরে আবদুল ওহাব আকন্দ, এম এ রশিদ এবং মার্কিন নাগরিক কেইজভি স্ট্যান্ডপোর্ট নামক ৩ জন পশুপাখি বিশারদের উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে শুধু মধুপুর জাতীয় উদ্যানেই ৫৮৪টি হনুমান এবং তিনগুণ বানর ছিল বলে উল্লেখ রয়েছে। মধুপুর গড়ের প্রাণিবৈচিত্র্য ধরে রাখার জন্য অনেক আগেই প্রস্তাবিত ইকোপার্কের ভিতরে লহুরিয়া বিট সংলগ্ন মিনি চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেটি এখন প্রায় পশুশূন্য অবস্থায় রয়েছে। হাতে গোনা ১০-১৫টি হরিণ আর কিছু বানর ও হনুমান ছাড়া অন্য কোনো বন্যপ্রাণী নেই। চিড়িয়াখানার শেডগুলো অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে এবং চিড়িয়াখানার কিছু জায়গাও বেদখল হয়ে গেছে। ফলে এ বনের বন্যপ্রাণী বানর, হনুমান ও হরিণসহ অন্য পশু-পাখিগুলো বনে আশ্রয় না পেয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে লোকালয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর দেশের বিবেকবান মানুষকে অশ্রুসজল চোখে সকরুণ মিনতি জানাচ্ছে বন রক্ষা করো, আমাদের বাঁচাও। পশুপাখি বিশারদ ও গবেষক অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের মতে, মধুপুর বনের বন্যপ্রাণীর বিস্তার ঘটাতে হলে অবিলম্বে জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধার, পরিবেশবান্ধব নয় এমন গাছ লাগানো থেকে বিরত থাকা এবং প্রাকৃতিক বনায়নের প্রতি গুরুত্বরোপ করতে হবে। এ ছাড়া অবৈধ শিকারী এবং বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সহকারী বন সংরক্ষক (টাঙ্গাইল উত্তর) আবু ইউসুফ বলেন, মধুপুর বনের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বানর-হরিণসহ বন্যপ্রাণীদের পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তারপরও যেহেতু এরা বন্যপ্রাণী সেহেতু লোকালয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার থাকে না বলে জানান।

সর্বশেষ খবর