বৃহস্পতিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রুমাল পার্টি

মির্জা মেহেদী তমাল

রুমাল পার্টি

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ থেকে ৮ বছরের শিশু প্রহর নিখোঁজ হয়। দুপুরে বাসার সামনে থেকে হঠাৎ করেই হাওয়া। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাইকিং করা হয়। পুলিশকে জানানো হয়। কিন্তু খোঁজ মেলে না প্রহরের। প্রহরের জন্য তার বাবা-মা পাগলপ্রায়। লোকমুখে তারা জানতে পারে, অজ্ঞাতনামা দুটি লোক প্রহরের নাকে রুমাল চেপেই কোলে নিয়ে একটি গাড়িতে তুলে নেয়। যারা দেখেছে, তারা বিষয়টি বোঝার আগেই গাড়ি লাপাত্তা। এমন খবরের পর প্রহরের বাবা মা নিশ্চিত হন, তাদের সন্তানকে অপহরণ করা হয়েছে। ঘটনাটি গত মঙ্গলবারের।   গতকাল ভোর ৪টায় কমলাপুর রেলস্টেশনে একটি শিশুকে পাওয়া যায়। প্লাটফর্মে ঘুমিয়ে ছিল। একটি কাঁথা দিয়ে শিশুটিকে ঢেকে রাখা হয়েছিল। আশপাশে ছিল আরও কয়েকজন। তারাও ঘুমে। ট্রেনের হুইসেলের শব্দে ঘুম ভাঙে পাশেই ঘুমিয়ে থাকা এক ব্যক্তির। লোকটি ঘুম থেকে উঠে পানি দিয়ে মুখ ধুচ্ছিলেন। তার ধোয়া পানির ছিটেফোঁটা গিয়ে পড়ে কাঁথা দিয়ে মুড়ে থাকা শিশুটির মুখের ওপর। ঘুম ভেঙে যায় শিশুটির। ঘুম ভাঙতেই কান্না শুরু করে। বাবা কোথায় মা কোথায় বলতে থাকে। লোকটি তার নাম-ঠিকানা জানতে চায়। কিন্তু ছেলেটি একেকবার একেক ধরনের কথা বলতে থাকে। এ সময় সিলেট থেকে ঢাকায় আসে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন। ট্রেনের একজন যাত্রীকে ডাক দেন লোকটি। সেই যাত্রী একজন পুলিশ কনস্টেবল। তার হাতে তুলে দিয়ে লোকটি চলে যান ট্রেন ধরতে। পুলিশ কনস্টেবল শিশুটির ঠিকানা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু সঠিক কিছুই বলতে পারছিল না শিশুটি। কথা জড়িয়ে আসছে। ঘুমের ঘোর পুরো কাটেনি। শিশুটি একবার নারিন্দার কথা বলায়, কনস্টেবল তাকে নিয়ে নারিন্দায় গিয়ে ঘুরতে থাকেন। কিন্তু শিশুটি চিনতে পারে না কিছু। তারা দয়াগঞ্জের মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। শিশুটি তখন কাঁদছিল। ওই পথে ডিউটিতে ছিলেন ওয়ারী জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার নূরুল আমীন। তিনি শিশুসহ এক লোককে ভোর বেলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জানতে চান সমস্যা আছে কিনা। কনস্টেবল নিজের পরিচয় দিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। নূরুল আমীন শিশুকে গাড়িতে তুলে নেন। কিছু সময় ঘোরাঘুরির পর সুস্থ হয়ে আসে শিশুটি। নারিন্দা হলুদ মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওই শিশু এলাকাটি পরিচিত বলে জানায়। নূরুল আমীন গাড়ি থেকে শিশুসহ নামেন। এ সময় ওই পথে যাচ্ছিলেন এক মহিলা। তিনি শিশুটিকে দেখে চিনতে পারেন। শিশুটির খালার বাসা সেখানেই। ওই পথচারী মহিলা তা জানেন। সেই খালার বাসায় যান পুলিশ কর্মকর্তা নূরুল আমীন। তারা প্রহরকে দেখে চিনতে পারেন। প্রহরের বাবা-মাকে ফোন করা হয়। তাদের দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় চলে আসতে বলেন নূরুল আমীন। সেখানে গিয়ে প্রহরকে হস্তান্তর করা হয়। প্রহর বলেছে, তার নাকে রুমাল চেপে ধরার পর আর কিছু মনে নেই। তবে রেলস্টেশনে একবার সে ট্রেন দেখেছে এটা সে বলেছে পুলিশের কাছে। প্রহর ভাগ্যক্রমে ফিরেছে তার বাবা-মার কাছে। রেলস্টেশনে যদি তার মুখে পানির ছিটেফোঁটা না লাগত হয় তো তার ঘুম ভাঙত না। ঘুম না ভাঙলে তার বাবা-মায়ের কাছে ফেরাও হতো না। তাকে নিয়ে যাওয়া হতো হয় তো অজানার উদ্দেশ্যে। প্রহরের মতো সব শিশুই ফিরে আসতে পারে না। কেউ ফিরে মুক্তিপণ দিয়ে। আর যারা মুক্তিপণের টাকা দিতে না পারে, তারা আর ফিরতেও পারে না। সারা দেশেই ভয়ঙ্কর রুমাল পার্টি সক্রিয়। তাদের দেখে চেনার কোনো উপায় থাকে না। রুমাল পার্টি তাদের হাতের রুমাল নাকে ধরলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে শিশুরা। এরপরই তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি অপহরণের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে র‌্যাব এমন একটি ভয়ঙ্কর চক্রের সন্ধান পেয়েছিল। ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের বন্দর থেকে অপহরণ করা হয় আট বছরের শিশু বায়েজীদকে। পরে অপহরণকারীরা বায়েজীদের মাকে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ না দিলে শিশুটিকে মেরে ফেলারও হুমকি দেয় তারা। তখন বায়েজীদের পরিবার বিষয়টি র‌্যাবকে জানায়। রাজধানীর গুলিস্তান থেকে সাহাবুদ্দিন ওরফে সেলিম ওরফে সাহেদ নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এই সাহাবুদ্দিন  শিশু অপহরণ ও পাচারকারী চক্রের হোতা। র‌্যাব তার কাছ থেকে পায় শিশু অপহরণের ভয়ঙ্কর তথ্য। র‌্যাব চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি অভিযান চালিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করে এবং অপহরণের সঙ্গে জড়িত আরও ছয়জনকে গ্রেফতার করে। এরা জিজ্ঞাসাবাদে ১৭ শিশুকে অপহরণ করার কথা স্বীকার করে। তাদের মধ্যে নয়জনকে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয় বলে জানায়। এ ছাড়া কয়েকজনকে বিদেশে পাচার করেছে এবং মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ দেওয়ার কারণে দুজন শিশু মারাও যায়, যাদের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেওয়া হয় বলে তারা স্বীকারোক্তিতে র‌্যাবকে বলেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, সমস্যা রয়েছে আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে। অজ্ঞতার কারণে অনেক সময় সঠিক ধারায় মামলা করা হয় না। ফলে অপরাধী উপযুক্ত শাস্তি পায় না বা শাস্তি এড়াতে পারে। এতে করে অপরাধীরা আস্কারা পায়। ছোট ও নিষ্পাপ শিশুদের অপহরণ করার পর টাকা আদায়ের টোপ বা কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করা নিকৃষ্টতম অপরাধ। এ ধরনের ঘটনা চলতে থাকলে তা মানুষের স্বাভাবিক জীবনকেই ব্যাহত করবে। শিশু অপহরণ রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপশি অভিভাবকদের মাঝেও সচেতনতা বাড়াতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর