শুক্রবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
শুক্রবারের প্রতিবেদন

আদর্শ মা-ই সন্তানের ভাগ্য নির্ধারক

অদম্য এক মা সীমা

আলপনা বেগম, নেত্রকোনা

আদর্শ মা-ই সন্তানের ভাগ্য নির্ধারক

সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা ও বৈরী পরিবেশকে উপেক্ষা করে এক মা ছেলেকে নিয়ে গেলেন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে সে। এখন ভার্সিটিতে পড়বে। স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি অদম্য মায়ের তালিকায় বিবিসির করা বিশ্বের ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় সীমা সরকার ৮১তম স্থানে রয়েছেন। পাশাপাশি শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলে হৃদয়ও ভর্তির সুযোগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআর সাবজেক্টে।

সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী তথা মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারপরেও অনেক মা তাদের কোলে শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তান এলে দুঃখের সীমা থাকে না। কিন্তু নেত্রকোনার জননী সীমা প্রমাণ করে দিলেন একজন মা-ই পারেন তার সন্তানের ভাগ্য বদলাতে।

শহরের কুড়পার এলাকার সমীরণ সরকার। তিনি একটি ইটের ভাটার ব্যবস্থাপক। সংসার চলে টানাপড়েনে। তাদের ঘরে ২০০০ সালে জন্ম নেয় এক শিশু। যার নাম রাখেন হৃদয়। কিন্তু তখন তারা জানতেন না হৃদয়ের জন্ম থেকে সেরিব্রাল পালসি নামের রোগ নিয়ে বড় হবে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে রোগটিও শনাক্ত হতে থাকে। যার চিকিৎসা নেই। তবুও সন্তানকে সুস্থ করে তুলতে কোনো প্রকার চিকিৎসা বাদ দেননি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এরপর সীমা সরকার প্রতিজ্ঞা করলেন জীবনে যত ঝড়ই আসুক তবু ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিয়ে যাবেন তিনি। কোনো বাধা-বিপত্তিই আটকাতে পারেনি অদম্য এই মা-কে। ছেলেকে ভর্তি করে দিলেন হলি চাইল্ড একাডেমিতে। প্রতিদিন কোলে নিয়ে গিয়ে বসে থাকতে হতো ছেলের সঙ্গে। এভাবে পঞ্চম শ্রেণি পাস করিয়ে তিনি ভর্তি করান শহরের স্বনামধন্য আঞ্জুমান সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। তিনতলা বিল্ডিংয়ে ছেলেকে বসিয়ে আসতেন। বাইরে বারান্দায় বসে কাটাতেন সময়। এমনি করে ২০১৬ সালে হৃদয় এসএসসি পাস করে। পরে তাকে নেত্রকোনা আবু আব্বাস ডিগ্রি কলেজে ভর্তি করেন। শিক্ষকদের আন্তরিকতা আর মায়ের কঠোর পরিশ্রমে এ বছর এইচএসসি পাস করে হৃদয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথটি খুলে গেল হৃদয়ের।

এবার যখন তিনি তার ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঢাকায় গেলেন, তখন ভিন্ন রূপে তিনি আবির্ভূত হন। ‘খ’ ইউনিটের পরীক্ষা। কলা অনুষদে পরীক্ষা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যখন হৃদয়কে নিয়ে পৌঁছলেন, তখন রিকশা থেকে নেমে ছেলেকে কোলে নিলেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র তাদের সাহায্য করতে চাইলেও তিনি তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমার ইচ্ছা, আমার ছেলেকে আমি নিজে পরীক্ষার হলে বসাব এবং কাছে থাকব। কলা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. আবু দেলোয়ার হোসেন স্যারের নিকট অনুমতি নিয়ে তিনি ছেলের পরীক্ষা কেন্দ্রের কাছে বারান্দায় থাকতে পেরেছেন বলে জানান। এদিকে ছেলেকে কোলে নিয়ে ভার্সিটিতে আসা-যাওয়ার ছবি তুলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সেই ছবি ভাইরাল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে রেজাল্টে মেরিট লিস্টে হৃদয়ের স্থান হয় ৩০৪৭। কিন্তু ভর্তির জন্য ফরম আনতে গিয়ে যত বিপত্তি দেখা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টি, শ্রবণ এবং বাক প্রতিবন্ধীদের কেবল ভর্তির সুবিধা রয়েছে। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধীর জন্য কোনো কোটা নেই। এ নিয়ে মিডিয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সুশীল সমাজ বেশ আলোচনা করেন। এ অবস্থায় ৯ নভেম্বর সিনেটের সভায় এই আইন সংশোধন করে তার ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া হয়। স্বপ্ন সত্যিই পূরণ হয় সীমা সরকারের। এ জন্য তিনি সিনেট ও মিডিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

বিবিসির করা বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন সীমা সরকার। তাঁর ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী হৃদয় সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের সাবজেক্ট আইআর (ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন) এ ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।

হৃদয়ের বাবা সমীরণ সরকার বলেন, আমার এই প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য আমার স্ত্রী যা করেছেন, তার তুলনা নাই। তার জন্যই হৃদয় এ পর্যন্ত যেতে পেরেছে। আমি আজ গর্বিত। আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের এই সন্তানের জন্য প্রতিবেশী থেকে শুরু করে মিডিয়ার লোকজন অনুপ্রাণিত করেছেন।

হৃদয়কে তার মার ব্যাপারে কিছু বলতে বললে সে বলে, ‘আমি যদি বিল্ডিং হই, আর সে বিল্ডিংয়ের সব পিলার হচ্ছেন আমার মা।’ আমার স্কুল থেকে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সব কিছুই মায়ের কৃতিত্ব। মা বলতেন, ‘তুমি লেখাপড়ার জন্য যতদূর যেতে চাও আমি তা সব টুকুই করব। মা তাই করেছেন’। হৃদয়ের আর এক ছোট ভাই আছে। তার নাম অন্তু সরকার। সে আঞ্জুমান সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র তবে সে স্বাভাবিক। সেও আজ তার মাকে নিয়ে গর্বিত। বিশ্বের ১০০ জনের মধ্যে তার নাম শুনে তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি এত কিছু বুঝি না। এই তালিকায় আরও আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মেয়ে চেলসি ক্লিনটন, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড (৩৬) ও পাকিস্তানের প্রথম হিন্দু নারী সিনেটর কৃষ্ণকুমারীর (৪৮) মতো নারীরা। এদিকে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম এমন খবরে হৃদয়কে প্রতিবন্ধী দিবসে আধুনিক একটি হুইল চেয়ার প্রদান করেন। যা দিয়ে হৃদয় এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণ করছে। পাশাপাশি পড়ালেখার ব্যাপারেও তিনি সহযোগিতা করবেন বলে অশ্বাস প্রদান করেন।

সর্বশেষ খবর