সোমবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

লাশঘরের কারসাজি

মির্জা মেহেদী তমাল

লাশঘরের কারসাজি

চাচার বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে বাসায় ফিরেনি কিশোরি চম্পা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। খবর নেই তার। পরিবারের সবাই তার খোঁজ করে। নাহ, কোথাও নেই। পাগলের মতো এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে সবাই। সারারাত কাটে অজানা আতঙ্কে। নতুন আরেকটা দিন আসে। সবাই যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়। চম্পার বান্ধবীরা যায় স্কুলে। কিন্তু শুধু চম্পা নেই। তাদের বাসায় তখন মাতম। থানা পুলিশকে জানানো হয়। তারাও খোঁজ খবর নিতে শুরু করে। হঠাৎ খবর আসে, বাগানের বড় একটি গাছে চম্পার লাশ ঝুলে আছে। খবরটি পাওয়ার পর ছুটে যায় পুলিশ। ছুটে যায় চম্পার পরিবার। লালপাড়ের হলুদ রঙের শাড়ি পরা চম্পার লাশ ঝুলে আছে একটি ডালের সঙ্গে।

চম্পার ভাই হাসিবুল ইসলাম হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন। তিনি আসামি করেন ছয়জনকে। কিন্তু তদন্তে খুনের কোনো আলামত খুঁজে পায় না পুলিশ। সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ এবং ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যার আলামত দেখতে পাননি বলে মত দেন তাদের প্রতিবেদনে। একজন আসামি গ্রেফতার হলেও এমন প্রতিবেদনের পর জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। হতাশ চম্পার পরিবার। প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন চম্পার ভাই। আদালতের নির্দেশে শুরু হয় নতুন করে তদন্ত। তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রকৃত রহস্য। আত্মহত্যা নয়, চম্পাকে ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। পরে তার লাশ বড় মোটা একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখে খুনিরা। যারা খুনের দায় থেকে রেহাই পেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে রায় হয়। বিচারে খুনিদের ফাঁসির রায় হয়। ২০১২ সালের ঘটনা এটি। চম্পা ফরিদপুর সদর উপজেলার কাশিমাবাদ গ্রামের জাহাঙ্গীর মিয়ার মেয়ে এবং স্থানীয় পুরদিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর রাতে নিজ বাড়ির পাশে সোহরাব শেখের মেহগনি বাগান থেকে চম্পার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আগের দিন চাচাতো বোনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গিয়ে নিখোঁজ হয় চম্পা।

২০১৬ সালে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের লাশ ময়নাতদন্তের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ফরেনসিক বিভাগ জানায় আত্মহত্যা। পরবর্তী সময়ে দিয়াজদের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে কবর থেকে তোলা হয় লাশ। ফের ময়নাতদন্ত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিকল্পিত হত্যাকাে র শিকার দিয়াজ। থানা পুলিশ হয়ে মামলাটি বর্তমানে সিআইডির তদন্তাধীন।

লাশঘরের কারসাজিতে হত্যাকা  প্রায়ই আত্মহত্যা হয়ে যায়। ভুক্তভোগী পরিবারদের অভিযোগ, পরিকল্পিত হত্যাকাে র ঘটনা ঘটলেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বলে অন্য কথা। সারা দেশে এমন অসংখ্য খুনের ঘটনা রয়েছে, যেগুলো তদন্ত কর্মকর্তা বা ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক কিংবা গুপ্তঘাতকের একক কারসাজিতে নতুবা তাদের সবার যোগসাজশে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়।

এমন বেশ কয়েকটি ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই খুঁজে পেয়েছে এমন লাশঘরের কারসাজির নানা ঘটনা। এসব ঘটনার কোনো কোনো লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে স্পষ্ট আঘাতের কথা উল্লেখ ছিল। কোথাও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেই ছিল খুনের স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা এসব কিছুই আমলে নেননি। শুধু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। অথচ পরে জানা যায়, লাশের ময়নাতদন্তই ভুল ছিল। আগে যে ঘটনাগুলোকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হয়েছিল, আদতে তা ছিল খুন।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বলছে, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকেরা ডোমদের ওপর ‘অতিমাত্রায়’ নির্ভরশীল। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রভাবকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রতিবেদন দেওয়া, সাক্ষী হওয়ার ভয়ে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের ময়নাতদন্তের কাজে অংশ না নেওয়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক না থাকাও ময়নাতদন্ত ভুল হওয়ার কারণ বলে মনে করে সংস্থাটি।

পিবিআই তাদের বেশ কটি ঘটনার তদন্তে উঠে এসেছে, যেগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বলা হলেও এসব ছিল পরিকল্পিত হত্যাকা­। প্রথমে ফরেনসিক চিকিৎসকরা ‘আত্মহত্যা’ বললেও পরবর্তী সময়ে খোদ খুনি আদালতে দাঁড়িয়ে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এমন বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনায় হত্যাকা­ের বর্ণনা, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, প্রশ্নবিদ্ধ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং এর নেপথ্য কারণ উল্লেখসহ পরবর্তী সময়ে পুলিশের করণীয় উল্লেখ করে পুলিশ সদর দপ্তরে সুপারিশযুক্ত প্রতিবেদন তুলে ধরেছে পিবিআই। ময়নাতদন্ত করে কেউ আত্মহত্যা করেছে, না হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে ফরেনসিক চিকিৎসকের মতামত দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন সিআইডির এক কর্মকর্তা।। তার মতে, ‘চিকিৎসক শুধু মৃত্যুর কারণ বলবেন। এটি হত্যা না আত্মহত্যা, সেটা বের করার দায়িত্ব পুলিশের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যান ও গবেষণা ইনস্টিটিউট সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘হত্যা বা অপমৃত্যু মামলার তদন্তে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভালো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মামলার রহস্য উন্মোচনে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সহায়তা করে। আবার একটি ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বিভ্রান্ত এবং ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছতে প্রভাবিত করে।’ তিনি বলেন, ‘সময় এসেছে আধুনিক যন্ত্রপাতিনির্ভর এবং প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত নিশ্চিত করার। তাহলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আর ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর