রবিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নরসিংদীতে টেঁটাযুদ্ধে এলাকাছাড়া ভোটারদের ভোট অনিশ্চতায়

সঞ্জিত সাহা, নরসিংদী

নির্বাচনের আমেজ নেই নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মেঘনা নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলে। কারণ টেঁটাযুদ্ধের ঘটনায় প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে ও মামলার আসামি হয়ে চরাঞ্চলের জনসংখ্যার অর্ধেকই এখন এলাকাছাড়া। বিএনপির দাবি, এ সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাদের ভোট প্রদান অনেকটাই অনিশ্চিত। ফলে নাগরিক দায়িত্ব ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে চরাঞ্চলের বিপুল জনসংখ্যার একটি অংশ। চরাঞ্চলের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। তবে আওয়ামী লীগ বলছে, উভয় পক্ষ চরাঞ্চলে প্রবেশ করলে ফের সংঘাতের ঘটনা ঘটতে পারে। আর প্রশাসন বলছে, ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে কেন্দ্রে এলে তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

নিলক্ষ্যা, বাঁশগাড়ী, চরমধুয়া, মির্জারচর, পাড়াতলী, চানপুর, শ্রীনগর ও চরআড়ালিয়া- নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মেঘনা নদীবেষ্টিত এই আটটি ইউনিয়ন চরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। রায়পুরা উপজেলার ২৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত নরসিংদী-৫ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৯৯ জন। এদের মধ্যে চরাঞ্চলের আটটি ইউনিয়নের মোট ভোটার এক লাখ ২ হাজার ২৭ জন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চরাঞ্চলের বাঁশগাড়ী ইউনিয়নে প্রয়াত দুই চেয়ারম্যান সিরাজুল হক ও সাহেদ সরকারের সমর্থকদের মধ্যে টেঁটাযুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে সিরাজুল হকের সমর্থকরা এলাকায় অবস্থান করলেও এলাকাছাড়া রয়েছেন সাহেদ সরকারের সমর্থকরা। নিলক্ষ্যা ইউনিয়নে সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হক সরকার ও সুমেদ আলীর সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এরই জের ধরে সুমেদ আলীর সমর্থকরা এলাকাছাড়া। মির্জাচরে চেয়ারম্যান ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জাফর ইকবাল মানিকের সঙ্গে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ফিরোজের ছেলে ফারুকুল ইসলামের বিরোধ রয়েছে। বর্তমানে চেয়ারম্যান মানিকের সমর্থকরা এলাকাছাড়া। পাড়াতলী ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান মাসুদের সঙ্গে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুজ্জামান তুহুর বিরোধ চলছে। বিষয়টি রাজনৈতিক সমঝোতা হলেও মাসুদের সমর্থকরা এলাকায় টিকতে পারছে না। চরআড়ালিয়ায় চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান সরকারের সঙ্গে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান সরকারের বিরোধ চলছে। বর্তমানে হাসানের সমর্থক শীর্ষ নেতারা এলাকাছাড়া আর সমর্থকরা রয়েছেন কোণঠাসা। চানপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল মিয়ার সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল কাদির জিলানীর বিরোধ রয়েছে। জিলানীর সমর্থকরা এলাকায় অবস্থান করলেও কোণঠাসা। চরমধুয়া ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুস সালাম শিকদার ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর আলম ফকিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলমান। দুই পক্ষ এলাকায় অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে উত্তেজনা রয়েছে। শ্রীনগর ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান চৌধুরী আজানের সঙ্গে সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজ মোর্শেদ রাসেলের দ্বন্দ্ব রয়েছে। উভয় পক্ষ এলাকায় অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে মতবিরোধ চলছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রায়পুরা উপজেলার চরাঞ্চলে টেঁটাযুদ্ধ অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে চরাঞ্চলের আটটি ইউনিয়নে টেঁটা-বল্লম ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলে আসছে। ছয়বারের ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল হক দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহতসহ বহু লোক টেঁটা-বল্লম ও গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে এ ইউনিয়নগুলোতে কয়েক হাজার ভোটার বাড়িঘর ছেড়ে পলাতক। প্রতিপক্ষের বিভিন্ন মামলায় আরও কয়েক হাজার ভোটার আসামি হয়ে এখন এলাকাছাড়া। যারা গ্রামে অবস্থান করছেন তারাও পেশিশক্তির হাতে জিম্মি। ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হলেও নির্বাচনের আমেজ নেই চরাঞ্চলে।

বাঁশগাড়ী ইউনিয়নে প্রবেশের আগেই পড়ে পাড়াতলী ইউনিয়নের আড়াকান্দা গ্রাম। সড়কের পাশেই প্রতিপক্ষের হামলায় দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে রয়েছে হোসেন মিয়ার বাড়ি। ওই বাড়ির পাশেই কথা হয় ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা আফিয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আট মাস আগে বাঁশগাড়ীর সিরাজুল হক চেয়ারম্যান মরার পর এই বাড়ির লোক প্যাঁচে পড়ে। ওই ঘটনার পরই এই বাড়ি ভাইঙ্গা ফেলে। এরপর আর তারা বাড়ি আইতে পারে নাই।’ একই সড়কে সামনে এগোলে বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের চরমেঘনা গ্রামের নুরু মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, বরকত উল্লাহর বিধ্বস্ত বাড়ি চোখে পড়ে। বাঁশগাড়ী বাজার থেকে ভিতরে ঢুকতেই বটতলী গ্রাম। সেখানে গিয়েও অনেক ভাঙাচোরা বাড়ি-ঘর দেখা যায়। তাদের অনেক বাড়িতেই মানুষ না থাকার চিহ্ন স্পষ্ট। দীর্ঘদিন ধরে মানুষ না থাকায় ঘরের দেয়াল ও মেঝেতে আগাছা জন্মেছে। একই চিত্র চরাঞ্চলের বিভিন্ন ইউনিয়নের। টেঁটাযুদ্ধে প্রতিপক্ষের হামলায় বিধ্বস্ত বাড়ি ও সাধারণ মানুষের আর্তনাদ বলছে নির্বাচনে তাদের বঞ্চনার কথা। বাঁশগাড়ী থেকে পালিয়ে আসা অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী নিলক্ষ্যা ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে। সেখানে কথা হয় এক পক্ষের নেতৃত্ব দেওয়া বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফয়সাল আহমেদ সুমনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শুধু বাঁশগাড়ীরই চার হাজারের অধিক নেতা-কর্মী এলাকাছাড়া। আমরা আওয়ামী লীগ করেও আজ ভেসে আসা আওয়ামী লীগের জন্য এলাকাছাড়া। দলকে ভালোবেসেও নির্বাচন করতে না পারা দুঃখজনক। আমরা এই অবস্থার পরিত্রাণ চাই। নির্বাচনে ভোট দিতে চাই।’ বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন বকুল বলেন, প্রতিপক্ষের হামলা ও মামলার আসামি হয়ে চরাঞ্চলের ৫০ হাজার ভোটার এখন এলাকাছাড়া। এত বিপুলসংখ্যক লোককে নির্বাচনের বাইরে রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু বলেছেন, চরের মানুষকে বিশ্বাস করা কঠিন। ভোট দেবে এটা কোনো সমস্যা নয়। তবে এ সুযোগে ফের সংঘাত হোক এটা কাম্য নয়।

সর্বশেষ খবর