রবিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বছরে ৩৬ বিলিয়ন ডলার আয়ের সুযোগ

মেরিটাইম শিক্ষা

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

বছরে ৩৬ বিলিয়ন ডলার আয়ের সুযোগ

বাণিজ্যনির্ভর বৈশ্বিক অর্থনীতির এই যুগে মেরিটাইম শিক্ষায় প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও শিক্ষিত মানবসম্পদ যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি। এ ছাড়া সমুদ্রসীমার পরিধি বৃদ্ধির কারণে সামুদ্রিক উৎস হতে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের পাশাপাশি এই সেক্টরে হাজারও কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। আর বাংলাদেশে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আধুনিক মেরিন শিক্ষায় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা ছাড়া কোনো গতিশীল ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে মেরিটাইম খাতের মানবসম্পদ চাহিদা বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। ইতিমধ্যেই ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও চীন মেরিটাইম খাতে জনবল রপ্তানিতে বেশ এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের সামনেও একটি মেরিটাইম সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বন্দরসহ মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে বিগত এক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগও বেড়েছে। প্রয়োজন পড়ছে প্রচুর দক্ষ জনবলের। তাই এখনই নবীনদের মেরিটাইম শিক্ষায় শিক্ষিত করে জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটিকে সমৃদ্ধ করার সময় এসেছে বলে জানান বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির কমান্ড্যান্ট ড. সাজিদ হোসেন।

বাংলাদেশের সম্ভাবনা : বিশ্বজুড়ে অফশোর ড্রিলিং, মেরিন এডুকেশন ও কনসালটেন্সির চাহিদা ঊর্ধ্বগামী। ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ বিশ্ব শিপিং সেক্টরে নতুন করে ৪২ হাজার ৫০০ অফিসার প্রয়োজন হবে। বিমকো আইসিএস জনশক্তি রিপোর্ট বলছেÑ ২০২৫ সালে এ খাতে ১ লাখ ৪৭ হাজার অফিসারের ঘাটতি থাকবে। এ ছাড়া অনশোরেও রয়েছে কাজের বিস্তৃত ক্ষেত্র। বাংলাদেশ সরকারও বর্তমানে এই খাতের অমিত সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সর্বোচ্চ মনোযোগী। জাপান, সিঙ্গাপুর, চীন, ভারত ও অন্যান্য উপকূলীয় দেশগুলো সম্প্রতি অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে বন্দর ও মেরিটাইম খাতগুলোর সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে। বাংলাদেশও এখন সে সম্ভাবনার পথে হাঁটছে। বর্তমান সরকার ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে নতুন পলিসি গ্রহণ করেছে এবং বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়নে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তন্মধ্যে মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা সমুদ্রবন্দর, বে-টার্মিনাল উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে দেশে ৩০০টির বেশি শিপইয়ার্ড এবং ওয়ার্কশপ রয়েছে, যার বেশিরভাগই বেসরকারি মালিকানাধীন। দেশের অভ্যন্তরে চলাচলকারী বিভিন্ন ধরনের জলযানের প্রায় শতভাগই ক্রমবর্ধনশীল। এ খাতে এই মুহূর্তে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি এবং সঠিক দিকনির্দেশনা।

খনিজসম্পদ আহরণে মেরিনার : দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমার তলদেশে মজুদ রয়েছে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেলের মতো জৈব জ্বালানি। এসব সম্পদের অনুসন্ধান, উত্তোলনে অফশোর স্থাপনা গড়ে তোলা, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করতেও প্রয়োজন প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল। জাহাজ থেকে শুরু করে বন্দরের যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনাগুলো এখন হয়ে পড়েছে প্রযুক্তিনির্ভর। তাই অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে মেরিটাইম সেক্টরে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে অনেক বেশি। মেরিটাইম খাতে সাফল্যের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে সময়োপযোগী মেরিটাইম শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে  মেরিটাইম খাত হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।

বাংলায় মেরিটাইম শিক্ষার ইতিহাস : নৌসভ্যতার শুরুর দিকে, খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দ থেকেই সমুদ্র বাণিজ্য, মৎস্য আহরণ, জাহাজ নির্মাণের মতো মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এই অঞ্চলের মানুষের বিশেষ দক্ষতা ছিল বলে জানা যায়। ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, ফরাসি পতাকাবাহী জাহাজে সৎ ও পরিশ্রমী নাবিক হিসেবে বাঙালিদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় কলকাতা, মুম্বাই, রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, কলম্বো বন্দরের বিভিন্ন সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজে অন্তত ৫০ হাজার বাঙালি নাবিক কর্মরত ছিলেন। তখন এসব দক্ষ পেশাজীবীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না, বরং বংশপরম্পরাতেই মেরিটাইমবিষয়ক বিভিন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছড়িয়ে পড়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

১৯৫২ সালে এসটিসি (বর্তমান ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মেরিটাইম শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়। পরে ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম টেকনোলজি (বিআইএমটি) এবং ১৯৬২ সালে মেরিন একাডেমি যাত্রা শুরু করে। স্বাধীনতার পর পর ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমি (বিএমএফএ)। এ ধারায় সর্বশেষ সংযোজন ২০১৩ সালে সরকারের বিশেষ আগ্রহে স্থাপিত দেশের প্রথম মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় বিএসএমআরএমইউ, যেখানে মেরিন পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব খাতকে এক ছাদের নিচে আনার উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সরকারি উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে আরও বেশ কয়েকটি মেরিন একাডেমি এবং দেশের প্রতিটি বিভাগেই গড়ে তোলা হচ্ছে নাবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বিভিন্ন মেরিটাইম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

মেরিটাইম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ : বিশ্বের ১২তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় মেরিটাইম বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে ঢাকার মিরপুর-১২ ক্যাম্পাসে ২০১৫ সাল থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় হামিদ চর এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে ১০৬.৬৬ একর জমির ওপর গড়ে উঠছে দেশের একমাত্র এই বিশেষায়িত মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস। দক্ষ জনবল তৈরি করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি অনুষদের আওতায় থাকবে ৩৮টি বিভাগ ও চারটি ইনস্টিটিউট। ২০২১ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হতে পারে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল। এ ছাড়া মেরিটাইম শিক্ষাদানে অনন্য ভূমিকা রেখে আসছে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট, মেরিন ফিশারিজ একাডেমি, বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি, ডেক অ্যান্ড ইঞ্জিন পার্সোনেল ট্রেনিং সেন্টার, বাংলাদেশ ওশেনোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রভৃতি। মেরিটাইম শিক্ষার জন্য বিশেষায়িত এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও  বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) রয়েছে নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ফিশারিজ এবং ওশেনোগ্রাফি বিভাগ, বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে এখানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ। খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ে রয়েছে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্সেস টেকনোলজি বিভাগ। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি অব ফিশারিজের অধীনে রয়েছে পাঁচটি ডিপার্টমেন্ট। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের আওতাধীন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) চালু করা হয়েছে নৌযন্ত্র ও নৌপ্রকৌশল বিভাগ। নারায়ণগঞ্জে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিতে ইঞ্জিনিয়ারিং  মেরিন টেকনোলজি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিপবিল্ডিং টেকনোলজি বিষয়ে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বেসরকারি মেরিন একাডেমি গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে ইউনাইটেড মেরিন একাডেমি, ওয়েস্টার্ন মেরিটাইম একাডেমি, কেমব্রিজ মেরিটাইম একাডেমি, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম একাডেমি উল্লেখযোগ্য।

মেরিটাইম শিক্ষায় সাদা তালিকায় বাংলাদেশ : মেরিটাইম শিক্ষায় ২০০০ সালে আইএমওর সাদা তালিকাভুক্ত (হোয়াইট লিস্ট) দেশের মর্যাদা লাভ করেছে বাংলাদেশ। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশও এখান থেকে প্রাপ্ত সনদ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করছে। শিপবিল্ডিং, শিপ রিপেয়ারিং, নেভিগেশন, মেরিটাইম লজিস্টিক, ট্রান্সবুক ম্যানেজমেন্ট, শিপিং পরিবহনসহ এ খাতে আন্তর্জাতিকভাবে সর্বমোট রাজস্ব আয়ের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার বিলিয়ন ইউএস ডলার। এ থেকে দুই শতাংশ আয়ও যদি বাংলাদেশে আসে, তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার।

সর্বশেষ খবর