বুধবার, ২২ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিদেশ মিশনের কাজ কী আর করছে কী

কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের কার্যক্রমে অসন্তোষ নীতি-নির্ধারণী সভায়, গতি বাড়াতে ৬ সিদ্ধান্ত

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বিদেশ মিশনের কাজ কী আর করছে কী

‘বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সব দেশে জিএসপির আওতায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাদে বাকি সব পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ। তাছাড়া জিএসপি ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) চুক্তির আওতায় আরও ১০/১২টি উন্নত রাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক উইংয়ে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলর ও প্রথম সচিবরা (বাণিজ্যিক) বিদেশে নতুন নতুন পণ্য রপ্তানিসহ বিদ্যমান রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে বিপুল ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু কয়েকজন কমার্শিয়াল কাউন্সিলের কার্যক্রম আদৌ সন্তোষজনক নয়।’ বৈদেশিক মিশনে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের কার্যক্রম সম্পর্কে এভাবেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন খোদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিজুল ইসলাম। গত ১৫ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বৈদেশিক মিশনগুলোর বাণিজ্য সংক্রান্ত কার্যক্রম গতিশীল করার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত ‘নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কমিটি’র ২০তম সভার কার্যবিবরণীতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ওই সভায় উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘এখনই রপ্তানি সম্প্রসারণে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না গেলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশকে অধিক শুল্ক পরিশোধসহ অনেক বৈদেশিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রপ্তানি সম্প্রসারণে বৈদেশিক মিশনগুলোর মাধ্যমে আমাদের কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। এরই মধ্যে মিশনগুলোর কার্যক্রমে গতি আনতে বেশ কিছু নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তবে রপ্তানি সম্প্রসারণে কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি আরও কিছু সুপারিশ রয়েছে আমাদের। বিশেষ করে যেসব পণ্যে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেসব পণ্যের গুণগত মান অক্ষুণœ রাখার ওপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকেও জোর দিতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে রপ্তানি খাতে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাত মূলত তৈরি পোশাকনির্ভর। এখন যেসব দেশ বাংলাদেশকে শুল্ক সুবিধা দিচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর আর সে সুবিধা দেবে না। তখনই আসল চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। আর এ চ্যালেঞ্জ উত্তরণে বিদেশে বাংলাদেশের পণ্যকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মিশনগুলো বর্তমানে যে পদ্ধতিতে কাজ করছে সেটি যথার্থ নয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ), অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির (পিটিএ) বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার; যাতে করে জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার হলেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে প্রত্যাশিত সুবিধা আদায় করা যায়। এজন্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক ও সভা-সেমিনার করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বৈদেশিক মিশনগুলোতে সরকারের এ নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বিভিন্ন মিশনে কর্মরত কাউন্সিলরদের অনেকের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সূত্রগুলো আরও জানায়, বিশ্বের একটি প্রভাবশালী দেশের  নেতৃত্বাধীন একটি অর্থনৈতিক ব্লক বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণে সমঝোতা চুক্তির (এমওইউ) আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি পাঠিয়েছে। দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে তারা বাণিজ্যমন্ত্রীকে নিমন্ত্রণও জানিয়েছে। কিন্তু ওই এমওইউ স্বাক্ষরে অন্যদিকের কে চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন সে বিষয়টি এখনো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দেশের মিশনে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলর। অথচ চুক্তি স্বাক্ষর হবে এ মাসেই। সূত্রগুলো আরও জানায়, তৈরি পোশাক বাদে সম্ভাবনাময় আরও কয়েকটি পণ্য যেমন: চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য ও চিংড়ি এবং পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত মার্চ মাসে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পণ্যভিত্তিক রপ্তানির যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে প্রায় ২৩ শতাংশ, চিংড়ি রপ্তানি কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ। বিভিন্ন দেশে এসব পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর জন্য বৈদেশিক মিশনগুলোর যে ধরনের কার্যক্রম বা উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার, তার অভাব রয়েছে। এমনকি অনেক মিশন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করতে পারছে না। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোরও অভিযোগ রয়েছে বৈদেশিক মিশনগুলোতে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে। ইপিবি  থেকে মিশনগুলোতে যাদের কাউন্সিলর করে পাঠানোর সুপারিশ করা হয় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা শুল্ক সম্পর্কে তেমন কোনো বাস্তব ধারণা থাকে না। ফলে রপ্তানি বৃদ্ধি সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হন তারা। এ ছাড়া বৈদেশিক মিশনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট দেশে সফররত ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলকে আশানুরূপ সহায়তা করেন না বলেও ব্যবসায়ীরা নানা সময় অভিযোগ করে থাকেন। সূত্র জানায়, বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিভিন্ন বিষয় আলোচনার পর  বৈদেশিক মিশনগুলোর কার্যক্রমে গতি আনতে নীতি-নির্ধারণী সভায় ৬টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলর ও প্রথম সচিবদের (বাণিজ্যিক) বাংলাদেশের রপ্তানি সম্প্রসারণে তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের আওতায় নতুন নতুন পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে; বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করা যায় কি-না তাও পর্যালোচনা করে নিয়মিতভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে এবং কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যুগোপযোগী করার জন্য গঠিত কমিটির প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর