বন্যার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনে বিলীন হচ্ছে নদীতীরবর্তী বিস্তীর্ণ জনপদ। ভাঙন আতঙ্কে ভিটেমাটি ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নিয়েছেন বানভাসিরা। নওগাঁ ও সিরাজগঞ্জে যমুনা এবং রংপুরে তিস্তার ভাঙন নতুন করে শুরু হয়েছে। ভাঙন রোধে এলাকায় জরুরি কাজ শুরু করেছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে ভাঙন। ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা ফসলি জমি। তিন সপ্তাহের বন্যায় প্রায় দুই শতাধিক বসতভিটা ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষ করে চৌহালী উপজেলার খাসপুকুরিয়ায় তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে চিরচেনা বসতভিটা। চলতি বছর সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর ৫টি উপজেলার ৪১টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। বন্যা ও ভাঙনে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে প্রায় ভাঙনে ১৫ হাজার সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো সবাই নিম্নআয়ের পরিবারের। অর্থ না থাকায় ঘর মেরামত করতে না পেরে ভাঙা ঘরেই জোড়াতালি দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকছে হচ্ছে। কৃষিনির্ভরশীল মানুষগুলোর ফসল ধান, পাট, আখ ও শাকসবজি নষ্ট হওয়ায় তারা আরও চরম বিপাকে পড়েছেন। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, চৌহালীর দুই কিলোমিটার অংশে ভাঙন শুরু হয়েছে। আপাতত ১১২ মিটার এলাকায় জরুরি কাজ শুরু করেছে। পর্যায়ক্রম অর্থ বরাদ্দ পেলে পুরো অংশে কাজ শুরু করা হবে। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মেদ জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের কাজ চলছে। কাজ শেষে মন্ত্রণালয়ে ক্ষতিপূরণের আবেদন জানানো হবে। মন্ত্রণালয় থেকে যদি বরাদ্দ দেয় তবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
রংপুর : বন্যার পর তিস্তাপাড়ে নতুন করে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। দিন দিন ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত ১০ দিনে ৩টি উপজেলায় অর্ধশত ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। তিস্তার ভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি, আবাদি জমিসহ নানা স্থাপনা। বাঁধ দিয়ে ভাঙন রক্ষার চেষ্টা করেও তেমন কাজে আসছে না। এ অবস্থায় নদীভাঙন থেকে স্থায়ী সমাধান চান ভাঙন কবলিতরা। প্রতি বছরই বন্যার পর ভাঙন শুরু হয় তিস্তার রংপুর অংশে। ভাঙনের ফলে জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাসহ গঙ্গচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা এলাকায় ঘরবাড়ি, জমিজমা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয় কয়েক লাখ মানুষ। এবারও বন্যার পর শুরু হয়েছে তিস্তার ভাঙন। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা। খরস্রোতা এই নদীর অব্যাহত ভাঙনে ছালাপাক, চিলাখাল, মটুকপুর, বিনবিনার চরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা হারিয়ে গেছে নদীতে। এদিকে শংকরদহ গুচ্ছগ্রাম, কাশিয়ানির চর, ইছলিসহ নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার লক্ষাধিক হেক্টর আবাদি জমি আজ তিস্তার গর্ভে। সাম্প্রতিক এই ভাঙনের ফলে জেলার কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরই মধ্যে তিস্তার ভাঙন রোধে বেশ কয়েকটি স্থানে বালির বস্তা, কংক্রিটের ব্লক ফেলা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী তবিবুর রহমান।রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, তিস্তার ভাঙন রোধে বরাদ্দ চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।নওগাঁ : নওগাঁর রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলায় ছোট যমুনা নদীর পানি কমে যাওয়ায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তাই এই বাঁধটি দুই উপজেলার মানুষের গলার কাঁটা। চরম আতঙ্কে রয়েছে রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলাবাসী। কারণ বাঁধটিতে দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার না করায় রাণীনগর উপজেলার ঘোষগ্রাম, নান্দাইবাড়ী, কৃষ্ণপুর ও আত্রাই উপজেলার ফুলবাড়ি, শাহাগোলা এলাকার প্রায় ৮ কিলোমিটার নদীর বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সম্প্রতি বন্যায় এই বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে প্লাবিত হয়েছিল কয়েকটি গ্রাম। এর পর পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ অন্যান্য দফতরের সহযোগিতায় স্থানীয়রা ভেঙে যাওয়া অংশটি মেরামত করায় বেঁচে যায় কয়েকশ গ্রাম, ফসলের মাঠ ও পুকুর-জলাশয়।
জানা গেছে, নদীর পানি আটকানোর জন্য আশির দশকে নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার গোনা ইউনিয়নের ঘোষগ্রাম, নান্দাইবাড়ী, কৃষ্ণপুর ও আত্রাই উপজেলার ফুলবাড়ি এলাকায় স্থানীয় সরকারের সহায়তায় স্থানীয়রা তৈরি করেন বেড়িবাঁধ। এরপর থেকে সরকারের কোনো দফতর এই বেড়িবাঁধের কোনো সংস্কার করেনি। স্থানীয়রা বাঁশ ও বালির বস্তা দিয়ে কোনো মতে রক্ষা করে আসছে এই বাঁধটি। কিন্তু বর্তমানে এই বাঁধের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। নদীতে পানি কমে যাওয়ায় ভাঙতে শুরু করেছে মাটির বড় বড় চাপ। ভাঙনের ফলে বাঁধের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়ার মতো কোনো রাস্তা নেই। যে কোনো সময় এই বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হতে পারে রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলার কয়েকশ গ্রাম আর শত শত বিঘা জমির ফসল। তবুও কোনো দফতরের নজর নেই বাঁধের দিকে।
নীলফামারী : বন্যার ফলে নীলফামারী জেলায় ৪০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা, প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৫টি ব্রিজ, সাড়ে আট কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া সাড়ে ৪৪ হেক্টর সম্পূর্ণ এবং সাড়ে ৬৭ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।