শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘাটে ঘাটে যত ভোগান্তি

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ২৫ কিমি যানজট, নৌঘাটে মানুষের চাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘাটে ঘাটে যত ভোগান্তি

বাস না পেয়ে শেষ মুহূর্তের ভরসা ট্রাক -জয়ীতা রায়

যমুনা সেতুর পুবপাশে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় ট্রেন চলাচলে বিপর্যয় ছাড়াও সড়কপথে টাঙ্গাইলে ২৫ কিলোমিটার ও পাটুরিয়া ঘাট-মানিকগঞ্জ পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট এবং শিমুলিয়া ফেরিঘাটে গাড়ি পারাপারে ধীরগতিতে ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষ সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হয়েছে। ট্রেনের শিডিউলে বিপর্যয়, বাস টিকিটের জন্য হাহাকার, পথে পথে যানজট, লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চলাচলসহ অন্তহীন ভোগান্তি সঙ্গী করেই ঘরে ফিরছে মানুষ। ঈদযাত্রার প্রথম দুই দিন মানুষ মোটামুটি স্বচ্ছন্দে বাড়ি যেতে পারলেও গতকাল এ ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপর্যয় নেমে আসে। গতকাল ঈদ ছুটি শুরু হওয়ায় রাজধানীর ট্রেন স্টেশন, বাস টার্মিনাল ও লঞ্চঘাটে ঘরমুখো যাত্রীর ভিড় উপচে পড়ে। আগাম টিকিটবিহীন যাত্রীরা বাসের আসন সংগ্রহে এক কাউন্টার থেকে আরেক কাউন্টারে ধরনা দিয়েছেন। গতকাল ভোর থেকেই রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশনে দেখা গেছে যাত্রীর উপচেপড়া ভিড়। অতিরিক্ত চাপ সামলাতে গতকাল থেকে রেলে যুক্ত হয়েছে তিনটি বিশেষ ট্রেন। কিন্তু ট্রেন দেরিতে আসায় ভোগান্তিতে পড়েছে যাত্রীরা। অধিকাংশ ট্রেন কমলাপুর ছেড়ে গেছে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস কমলাপুর ছেড়ে যাওয়ার সময় ছিল সকাল ৬টা। কিন্তু সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ট্রেনটি কমলাপুর পৌঁছায়নি। ১১টার পর এটি কমলাপুর এসে পৌঁছালে তা ছাড়তে সাড়ে ১২টা পেরিয়ে যায়। যাত্রীদের দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অপেক্ষাসহ সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। শুধু ধূমকেতু এক্সপ্রেসই নয়, গতকাল প্রায় সব ট্রেনই ছাড়তে বিলম্ব হয়েছে। এবার ট্রেনের ধারাবাহিক শিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনায় ঈদযাত্রীদের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। রংপুর এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস, সুন্দরবন এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলকারী ট্রেনে প্রতিদিনই শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। কমলাপুর রেল স্টেশনের ম্যানেজার আমিনুল হক বলেন, ‘ঈদযাত্রায় প্রচুর যাত্রীর চাপ থাকায় ট্রেনের গতি যেমন কম থাকে, তেমনি প্রতি স্টেশনে যাত্রী ওঠানো-নামানোয় অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। এজন্য মূলত কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। ট্রেনের যাত্রায় যেন বিলম্ব না হয় সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’ ঈদযাত্রায় সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটে বঙ্গবন্ধু সেতুর পুবপাশে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায়। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের দুটি বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় দুপুর সোয়া ১টা থেকেই উত্তরবঙ্গের ২১ জেলার সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ দুর্ঘটনার কারণে উত্তরাঞ্চল ও পশ্চিম রেলের ট্রেনগুলোর সময়সূচিতে বড় বিপর্যয় তৈরি হয়। জানা গেছে, খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেসের ওই ট্রেনটি গতকাল বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটে গন্তব্যে ছেড়ে গেছে। এ দুর্ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও এ পথ দিয়ে ঢাকা থেকে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় সিরাজগঞ্জ অংশে গাড়ি টানতে না পারায় অতিরিক্ত গাড়ির চাপে বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকা থেকে করটিয়া পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে ঈদে ঘরমুখী যাত্রীরা। বঙ্গবন্ধু সেতু থানা পূর্ব-এর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে মহাসড়কে গাড়ির চাপ বাড়ে। এতে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর অতিরিক্ত লোড পড়ে বিধায় বেলা ১১টার দিকে টোল প্লাজা ১০ মিনিট বন্ধ রাখা হয়। বেলা ১২টার দিকে দ্বিতীয় দফায় টোল প্লাজা বন্ধ রাখা হয়।

কালিয়াকৈর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ঈদে ঘরমুখী মানুষের চাপ বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। বেড়েছে যাত্রী ও যানবহনের চাপ। তবে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ উঠেছে। একাধিক যাত্রী জানান, গতকাল সকাল থেকে ঘরমুখী মানুষের চাপ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি যানবাহনের আধিক্যের কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড়ে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। এদিকে গত রাত থেকে বৃষ্টি হওয়ায় যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে। মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেও অস্বাভাবিকভাবে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পাটুরিয়া ঘাট থেকে ২০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায় গাড়ির লাইন। এ ছাড়া মহাসড়কের ওপর বিভিন্ন পয়েন্টে চারটি বাস বিকল হওয়ায় যান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে চরমভাবে। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌপথে ফেরি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় ওই পথের গাড়িগুলোও পাটুরিয়ায় আসার ফলে গাড়ির চাপ বেড়ে গেছে। বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঈদযাত্রায় পাটুরিয়া ঘাটে সব ধরনের গাড়ির চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০টি ফেরি দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। মাদারীপুর ও মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকায় গতকাল সকাল থেকে ঈদে ঘরমুখী যাত্রীর চাপ বেড়েই চলেছে। শিমুলিয়া প্রান্ত থেকে সব ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট শিমুলিয়া ঘাট থেকে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে কাঁঠালবাড়ী ঘাটে এসে ভিড়ছে। যতই সময় বাড়ছে ততই যাত্রী চাপ বেড়ে চলেছে। কাঁঠালবাড়ী ও মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে ১৮টি ফেরি, ৮৭টি লঞ্চ ও ২ শতাধিক স্পিডবোট চলছে। বিআইডব্লিউটিসির কাঁঠালবাড়ী ঘাটসূত্রে জানা গেছে, আবহাওয়া স্বাভাবিক হওয়ায় সকাল থেকে লঞ্চ ও স্পিডবোট চলা শুরু করেছে। তবে ঢেউ ও স্রোত থাকায় লঞ্চ চলাচলে একটু সময় বেশি লাগছে। সদরঘাটে মানুষের ঢল : সড়কপথের পাশাপাশি নৌপথেও বাড়ি ফেরা মানুষের উপচে পড়া ভিড় লেগেছে। দক্ষিণবঙ্গের মানুষের স্রোত পড়েছে রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাটে। সকাল থেকেই সদরঘাট টার্মিনালগুলোয় দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীর চাপ ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীচাপ আরও বেড়ে যায়। টার্মিনালে প্রবেশপথে টিকিট কাউন্টারে যাত্রীর দীর্ঘ লাইন। পন্টুনগুলোয় যাত্রীর জটলা। খানিক সময়ের মধ্যে লঞ্চ যাত্রী বোঝাই হয়ে যাচ্ছে। সরেজমিন লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে যাত্রীবোঝাই লঞ্চ। তবে অনেক যাত্রী অভিযোগ করেছেন, সময়মতো লঞ্চ ছাড়ছে না। সকাল থেকে দেখা যায়, লঞ্চ যখন ছাড়ার কথা তার এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর ছাড়ছে। ফাঁকা হচ্ছে ঢাকা : আর মাত্র এক দিন বাদে উদযাপিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে নাড়ির টানে গ্রামের বাড়ি যেতে শুরু করেছেন ঢাকাবাসী। মানুষের চাপ কমতে থাকায় ফাঁকা হতে শুরু করেছে ঢাকা। চিরচেনা যানজটের দৃশ্য বদলাতে শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে ঈদে বাড়িমুখো মানুষ রাজধানী ছাড়তে শুরু করলেও গতকাল উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছাড়েন। যানজট না থাকায় ঢাকার রাজপথে যানবাহন ও গণপরিবহনগুলোকে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে দেখা যায়। ফলে রাজধানীতে এখন অনেকটাই ঈদের আমেজ বিরাজ করছে। গতকাল ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে যানজট ছিল না বললেই চলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালত, সরকারি-বেসরকারি অফিসসহ ব্যাংক এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় ঢাকার সড়কগুলোতে মানুষের তেমন চাপ ছিল না। তবে রেলস্টেশন, সদরঘাট এলাকা ও রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালে মানুষের ভিড় কিছুটা লক্ষ্য করা যায়। ঢাকার যেসব এলাকায় কোরবানির পশুর হাট বসেছে সেখানেও কিছুটা ভিড় দেখা যায়। এবার ১৬ আগস্ট এক দিন ছুটির ব্যবস্থা করতে পারলেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঈদের আগে-পরে মিলিয়ে পাচ্ছেন টানা ৯ দিনের দীর্ঘ ছুটি। আর এরকম লম্বা ছুটিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছাড়ায় ঢাকাবাসীও টানা কয়েক দিন যানজটহীন শহরে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করার সুযোগ পাবেন। তবে ডেঙ্গু জ্বরের কারণে এবার অন্যান্য বারের তুলনায় কিছু কম মানুষ ঢাকা ছাড়বেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাস্তাঘাটে যানজট কম থাকায় গতকাল ছুটির দিনের বিকালে অনেকেই রিকশা করে ঘুরতে বের হন। রিকশাচালকদেরও ফুরফুরে মেজাজে রিকশা চালাতে দেখা যায়। একই সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশদেরও বেশ নির্ভার দেখা যায়। তবে ঢাকা ফাঁকা পেয়ে তরুণরা ঝুঁকিপূর্ণভাবে দ্রুতগতিতে প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল চালায়। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর