বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

টার্গেট বিবাহিত ব্যবসায়ী

মির্জা মেহেদী তমাল

টার্গেট বিবাহিত ব্যবসায়ী

সুন্দরী মডেলদের দিয়ে ফাঁদে ফেলে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভুয়া ডিবির একটি চক্র। সম্প্রতি প্রতারণার শিকার ইমতিয়াজ নামের এক ব্যবসায়ীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তে নামে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পূর্ব বিভাগ। গ্রেফতার করা হয় প্রতারক চক্রের সদস্য নারীসহ মোট ছয়জনকে। শ্যামলীর গার্ডেন সিটির ২৩/১০ নম্বর বাসার এ-২ নম্বর ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। অভিযানে ওই বাসা থেকে চট্টগ্রামের বন্দরটিলা ইপিজেড এলাকার ওয়াহেদুল খানের মেয়ে সুন্দরী মডেল জেরিন খান ওরফে জেরিন খ্রিস্টা (২৩) এবং প্রতারক চক্রের মূল হোতা রেহানা জামান পপিকে (৩৫) গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অস্ত্র ও ওয়াকিটকিসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজ্জাক হোসেন রাজ, জাকির হোসেন, খসরু ও শহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর ও মতিঝিল থানায় পৃথক মামলা করা হয়। অভিযানে অংশ নেওয়া ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওই দুই নারী জেলহাজতে আটক আছেন। অস্ত্রসহ গ্রেফতার ব্যক্তিদের দুজনকে রিমান্ডে নিয়ে আরও দুজনের নাম পাওয়া যায়। তাদেরও গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। মামলার বাদী ও ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘ধাপে ধাপে তারা আমার কাছ থেকে মোট ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এভাবে আরও অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করেছে তারা।’

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জেরিন জানিয়েছে, সুন্দরী মডেলদের দিয়ে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের ফাঁদে ফেলে এ চক্র। এরপর ভুয়া ডিবি পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার ও পরিবারকে জানানোর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এর মূল হোতা পপি। শ্যামলীর জাপান গার্ডেন সিটিতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে তিন বছর ধরে এ প্রতারণা করে আসছিল তারা। তাদের চক্রে শুধু সুন্দরী মডেলরা নয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও আছে, যারা ভুয়া ডিবি সেজে টাকা আদায় করে। জেরিন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতানো টাকা রাখত ইস্টার্ন ব্যাংকে নিজের অ্যাকাউন্টে। ছয় মাস আগেও শাকিল নামে এক ব্যবসায়ীকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ে ফেলে ১২ লাখ টাকা আদায় করেছে সে। মূলত তাদের প্রধান টার্গেট থাকে বিবাহিত ব্যবসায়ীরা। তারা সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় টাকা দিতে বাধ্য হন। মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, এ চক্রের মূল টার্গেট শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদ এবং মোটা বেতনের চাকরিজীবী। তবে শিল্পপতিদের সঙ্গে কোনো প্রতারণা করা হতো না। শিল্পপতিদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে যেত তারা। বিনিময়ে চক্রের অন্য সদস্যদের আদায় করে দেওয়া হতো মোটা অঙ্কের টাকা। ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই রাজধানীতে সক্রিয় চক্রটি। প্রতি মাসেই এক বা একাধিক ব্যবসায়ীকে অভিনব কায়দায় ফাঁদে ফেলে ধাপে ধাপে টাকা আদায় করে আসছে। জেরিন ছাড়াও ঐশীসহ আরও কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। আর জেরিন যে গাড়িটি ব্যবহার করে সেটিও প্রতারণার মাধ্যমে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া। গ্রেফতারের কয়েক দিন আগেও এক শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠানের মালিকের ছেলের সঙ্গে দেখা করে ২০ হাজার টাকা নিয়েছিল সে।

যেভাবে ফাঁদে ফেলা হয় : চক্রের সুন্দরী মডেলরা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, বড় চাকরিজীবীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। এরপর তারা মোবাইল নম্বর আদান-প্রদান করে কথা বলা শুরু করে। কয়েক দিন কথা বলে তারা বাইরে দেখা করে এবং ঘুরতে যায়। পরে সুযোগ বুঝে নির্ধারিত বাসায় ডেকে আনা হয় টার্গেটে থাকা ব্যক্তিদের। বাসায় কিছু সময় কাটানোর পরই সেখানে হাজির হয় ভুয়া ডিবি চক্রের সদস্যরা। আপত্তিকর মুহূর্তের ছবি তুলে এবং গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। কেড়ে নেওয়া হয় সঙ্গে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড। পরে টাকা দিতে রাজি না হলে ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া এবং পরিবারকে আপত্তিকর ছবি দেখানোর হুমকি দেওয়া হয়। এভাবেই বছরের পর বছর চলে তাদের প্রতারণা।

এ চক্রে যেভাবে জড়ায় জেরিন : সিনেমার নায়িকা হওয়ার আশায় পরিবারকে না জানিয়ে ঢাকায় আসে জেরিন। তার এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয় পরিচালক রয়েলের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত সিনেমায় অভিনয় করা হয়ে ওঠে না তার। তবে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করে। এর একপর্যায়ে পরিচয় হয় রেহানা জামান পপির সঙ্গে। পপির হাত ধরেই সে যোগ দেয় ভুয়া ডিবি ও সুন্দরী মডেলদের নিয়ে গঠিত অভিনব প্রতারক চক্রে। ফাঁদে ফেলতে টার্গেট করে বিত্তবানদের। এভাবেই অল্প দিনে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ও গাড়ির মালিক বনে যায় জেরিন।

সর্বশেষ খবর