বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

টার্গেট ফেসবুকের নারী

মির্জা মেহেদী তমাল

টার্গেট ফেসবুকের নারী

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, মিডিয়া কর্মী, দেশজুড়ে পরিচিত সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে ভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও গৃহিণীÑ কারও ফেসবুক আইডি হ্যাক করা আর বাকি নেই। গড়ে তুলেছেন ফেসবুক আইডি হ্যাক করার বিশাল সাম্রাজ্য। অনেককেই ব্ল্যাকমেইল করে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। অশ্লীল ছবি বা ভিডিও তৈরি করে পাঠিয়ে কারও ভেঙেছেন সংসার। কখনো আবার র‌্যাব কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে মানুষকে হুমকি দিয়েছেন, টাকা-পয়সা নিয়েছেন। তাদের মূল টার্গেটে ফেসবুক ব্যবহারকারী নারীরা। এমন চক্রের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব।

ভয়ঙ্কর এ সাইবার অপরাধী চক্রের সব তথ্য ইতিমধ্যে সংগ্রহ করেছে র‌্যাব। র‌্যাবের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে  তাদের অপরাধের সব চিত্র। গ্রেফতার করা হয়েছে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার তিতারকোনা মামদনগর গ্রামের মৃত ইজাজুর রহমানের ছেলে মাহফুজুর রহমান নবীনকে (২৮)। তার বিরুদ্ধে র‌্যাব-৯ সিলেটের এসআই পঙ্কজ দাশ বাদী হয়ে সাইবার অপরাধের অভিযোগে মামলাও করেছেন।

মামলার এজাহারে তার অপরাধের ১৩৯ পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট জমা দেওয়া হয়েছে। আর সাইবার অপরাধীদের তথ্যের ১ হাজার ২৬৫ পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট সংগ্রহ করেছে র‌্যাব। বাহুবল থানায় সোপর্দ করা হয়েছে তাকে। এসব তথ্য নিশ্চিত করে র‌্যাব-৯-এর সিলেটের অপারেশন অফিসার শামীম আনোয়ার জানিয়েছেন, ‘তার একটি বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। সে সেলিব্রেটি থেকে গৃহিণী- কারও ফেসবুক হ্যাক করার বাকি রাখেনি। ফেসবুক হ্যাক করে টাকা-পয়সা চায়। বলে, “টাকা দিলে আইডি ফিরিয়ে দেব। অন্যথায় এটি ডিজ্যাবল করে দেব”।’ তিনি বলেন, ‘মেয়েদের ফেসবুক আইডি হ্যাক করার পর সে ছবি, ভিডিও সংগ্রহ করে তা এডিট করে ওই আইডির মালিকের কাছে পাঠিয়ে দিত। এরপর মেয়েদের ফাঁদে ফেলে অশ্লীল আচরণ করত। এই অপরাধী অসংখ্য মানুষের সংসার ভেঙেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই সে এমন একজন অপরাধী। তার বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা আরও অনেক বেশি দক্ষ। সেগুলোর অনুসন্ধান চলছে। খুব দ্রুতই তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের উপস্থাপিকার ফেসবুক আইডি হ্যাকড হওয়ার সূত্র ধরে নবীনের সাইবার অপরাধ সাম্রাজ্যের বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। ব্যক্তিগত প্রণোদনা থেকে একটু গভীরে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে যা আবিষ্কার করলাম, তা রীতিমতো চমকে ওঠার মতোই। ফেসবুক আইডি হ্যাক করে টুপাইস কামিয়ে নেওয়ার মতো প্রথাগত সাইবার অপরাধী আর ঠুনকো কাজের কাজি নয় সে মোটেও। তার কাজের বহুমাত্রিকতা সত্যিই একজনের মাথা খারাপ করে দেওয়ার তরফে যথেষ্ট। আনোয়ার আহমেদ, কামরুজ্জামান আইডিগুলো ভিন্ন ভিন্ন হলেও মানুষ কিন্তু একটাই। পেশায় র‌্যাব অফিসার (!)। র‌্যাবের ডিএডি পরিচয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ঘিরেই তার অপরাধ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি। তার শিকারের আওতা থেকে বাদ যান না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, মিডিয়া কর্মী, দেশজুড়ে পরিচিত সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী কিংবা আটপৌরে জীবনযাপনকারী সাধারণ একজন চাকরজীবী বা গৃহিণীও। একের পর এক ব্যক্তিকে টার্গেট করে তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করার মাধ্যমে অকল্পনীয় সব উপায়ে সাইবার অপরাধ সংঘটন করে সে। হ্যাকড আইডি ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়, সম্ভাব্য সব উপায়ে তার সম্মান বিনষ্ট করে।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা হলো, সবশেষে এ আইডিগুলোকে সে নিয়োজিত করে বড় বড় সাইবার অপরাধ সংঘটনের কাজে! তার অপরাধ প্রক্রিয়ার বয়ান শুনলে নিশ্চিত শিউরে উঠবেন যে কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক, বিবেকবান মানুষ। টার্গেট করার ক্ষেত্রে নারীদের ফেসবুক আইডির প্রতিই এর বিশেষ নেকনজর। হ্যাক করার পর প্রথমে সে আইডির মালিককে মানসিক চাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে আইডিতে থাকা একান্ত ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও, ডকুমেন্টসহ বিভিন্ন জনকে পাঠিয়ে দিতে থাকে। আইডির মালিক “আপসে” আসুন বা না আসুন, সে কখনই ওই আইডি তার মালিককে ফেরত দেয় না। বরং আইডির ছবি, ইনফোগুলো পরিবর্তন করে কোনো কোনোটাকে সাজিয়ে নেয় র‌্যাব অফিসার, আবার কিছু আইডির পরিচয় রেখে দেয় আমজনতা হিসেবেও। তারপর এ আইডিগুলো ব্যবহার করে শুরু হয় তার বিভিন্নমুখী বিচিত্র “আসল” খেলা।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে আমজনতা হিসেবে সাজানো একটা আইডি থেকে নবীন একটা হেল্প চেয়ে পোস্ট দেয়। তারপর র‌্যাব অফিসার হিসেবে সাজানো আইডি থেকে সেখানে কমেন্ট করে অনুরোধ করে ইনবক্স মেসেজে কথা বলতে। কারণ সে তো আবার র‌্যাবের অফিসার! প্রকাশ্যে কথা বলা বারণ। কয়েক দিন পর প্রথম আইডি থেকে পোস্ট করে বলা হয়, অমুক র‌্যাব অফিসার (যে আইডি থেকে ইনবক্সে আসতে বলা হয়েছিল তার নাম উল্লেখ করে) তার জমি বা হারানো মোবাইল ফোন সেটটি উদ্ধার করে দিয়েছে। এজন্য তাকে অনেক অনেক থ্যাংকস, কৃতজ্ঞতা এসবও জানায়! যারা প্রকৃতই এ ধরনের সমস্যায় আছেন তারা ভাবেন আহারে! কী দরদি অফিসার! অবধারিতভাবে ওই র‌্যাব অফিসারের আইডিতে বিভিন্ন জন তাদের সমস্যার কথা বলতে থাকেন। তখনই (ভুয়া) র‌্যাব অফিসার সুযোগটা নেয়। সহযোগিতা করার বিনিময়ে টাকা দাবি করে। বিকাশের মাধ্যমে অগ্রিম টাকা না পাঠালে কাজ করা হবে না মর্মেও সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেয়। কারণ, এ কাজ করতে গেলে র‌্যাবের প্রযুক্তিবিশারদের হেল্প প্রয়োজন। সেজন্য তাকে কিছু টাকা দিতে হবে। সাহায্যপ্রার্থীও কনভিন্সড। র‌্যাব অফিসার বলে কথা! একটু স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড তো সে হবেই। বাস্তব জগতের র‌্যাবগুলা জানি কেমন! একটা টাকাও নিতে চায় না, কোনো হেল্পও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। আরে, অফিসার তো হতে হবে এই উনার মতো। দুই টাকা নেবে, দশ টাকার কাজ করে দেবে। অগ্রিম দেওয়ার প্রস্তাবে কেউই আপত্তি করেন না। এভাবে বিভিন্ন কৌশলে দিনের পর দিন পকেট ভারী করে চলে নবীন।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর