মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ছোট বিজ্ঞাপনের ভয়ঙ্কর মানুষ

মির্জা মেহেদী তমাল

ছোট বিজ্ঞাপনের ভয়ঙ্কর মানুষ

হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়ায় খুব খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয় মামুনুর রশিদকে। স্ত্রী আর এক সন্তানকে নিয়ে কষ্টে কাটতে থাকে তার দিন। চারদিকে রাজ্যের হতাশা নিয়ে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা থেকে ঢাকায় আসা মামুনুর চাকরির খোঁজে ঘুরে বেড়ান। বেকারত্বের এই সময়টুকুতে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজে বেড়াতেন। এর মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘ভিসা প্রসেসিং’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে তার। তিনি ভাবেন, চাকরি যেহেতু হচ্ছেই না, বিদেশ চলে যাবেন। যেই চিন্তা, সেই কাজ। বিজ্ঞাপনে দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেন মামুন। বিজ্ঞাপনে অফিসের ঠিকানা দেওয়া ছিল উত্তরা এলাকার। ওই নম্বরে ফোন করার পর নাজমুল হাসান সুমন নামের একজন ফোন রিসিভ করেন। তিনি মামুনকে রাজধানীর একটি বিপণিবিতানে দেখা করতে বলেন। মামুন তাকে বলেন, আপনাদের অফিস উত্তরায়। কেন বিপণিবিতানে দেখা করবেন। তখন নাজমুল বলেন, সেখানে তাদের অনেক ক্লায়েন্ট আসেন। সেখানেই তারা এসব বিষয়ে বেশিরভাগ সময় আলোচনা করেন। এর পরের দিন নাজমুলের কথামতো মামুন ওই মার্কেটে গিয়ে অপেক্ষা করেন। সেদিন নাজমুল তাকে তার বস তানভীর আহমেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তানভীর মামুনকে বলেছিলেন, খুব দ্রুতই তার হংকংয়ের ভিসা হয়ে যাবে। আর সব খরচ বিদেশে যাওয়ার পরেই নেবেন তারা। তাদের দুজনের কথা শুনে মামুনের ভালো লাগে। বিশ্বাস করে। এ জন্য প্রথমে ভিসার ফি ২০ হাজার টাকা তাদের দেন মামুন। এর কয়েক দিন পর মামুনের কাছে আরও ২০ হাজার টাকা চায় তানভীর। তিনি জানান, ভিসা হয়ে গেছে। এখন বিমানের টিকিটের দাম দিতে হবে। এর ঠিক দুই দিন পরে তানভীর মামুনকে একটি বেসরকারি এয়ার লাইনসের টিকিট ও ভিসার কাগজ দেন। তানভীর তাকে একটি তারিখ দিয়ে জানায়, সেদিনই তার ফ্লাইট। তবে সরাসরি হংকং যাওয়া যাবে না। নেপাল হয়ে হংকং যেতে হবে। মামুন টিকিট হাতে পেয়ে খুশি। তবে দুই দিন পর তানভীর তাকে জানায়, তার পাসপোর্টে কিছু ডলার এক্সচেঞ্জ করতে হবে। মামুন এ সময় তার গ্রামের জমিজমা বিক্রি করেন। জমি বিক্রির চার লাখ টাকা তুলে দেন তানভীরের কাছে। কিন্তু সেদিন বিকালেই তানভীর জানায়, ডলার এক্সচেঞ্জ করা সম্ভব হচ্ছে না, পরদিন করা যাবে। পরের দিন আবারও ফোনে কথা হয়। তারা বলে, ফ্লাইটের আরও দুই দিন বাকি আছে। সমস্যা নেই। তার আগেই আপনার পাসপোর্ট ও ডলার পেয়ে যাবেন। কিন্তু এরপর থেকেই তানভীর আর নাজমুলের ফোন বন্ধ। মামুন বুঝতে পারে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এর পর শুরু হয় মামুনুরের জীবনের নির্মম অধ্যায়।

বাবার জমি বিক্রির টাকা ও শ্বশুরের অবসর ভাতার টাকা সব কিছু খুইয়ে এখন নিঃস্ব মামুন। এভাবে নিঃস্ব শুধু  মামুনুর রশিদই নয়, তার মতো আরও অনেকে প্রতারিত হয়েছেন তানভীর-নাজমুলের কাছে। এ ঘটনায় ভাটারা থানায় একটি মামলা করেন মামুন। এ বছরের শুরুতে সিআইডি থেকে ফোন পান মামুন। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা ফোন করে মামুনকে জানান, তানভীর ও নাজমুল নামে দুই প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে মামুনের নম্বর পায় সিআইডি। মামুনের মতো আরও বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীকে ডেকে নিয়ে সিআইডি প্রতারকদের শনাক্ত করে।

সিআইডি জানায়, তানভীর আর নাজমুল পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে হংকং পাঠানোর নামে প্রতারণা করে আসছিল। এ দুজন প্রথমে বিজ্ঞাপন দেয়। এরপর তাদের দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে তারা পরবর্তী ফাঁদ পাতে। তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে লাখ লাখ টাকা হারিয়েছেন অনেকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপন ছাপানোর ক্ষেত্রে একটু সতর্ক হলে বা যাচাই-বাছাই করে ছাপানোর ব্যবস্থা করলে এ ধরনের প্রতারকরা এ সুযোগ নিতে পারবে না। আর যারা বিজ্ঞাপন দেখেই সরল বিশ্বাসে ফাঁদে পা দিচ্ছেন, তাদেরও প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির দেওয়া তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পরই চুক্তি বা লেনদেনে যাওয়া উচিত। তাহলেও এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।

সর্বশেষ খবর