এবার দেশের পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজি বন্ধে বিশেষ শুদ্ধি অভিযান শুরু হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ খাতে বিরাজমান অরাজকতা, অব্যবস্থাপনা, চাঁদাবাজির ভয়াবহতা এবং গুটিকয় গডফাদারের ক্ষমতার অপব্যবহারের নানা নজিরবিহীন তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। এসব নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন দাখিলের পরপরই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
রাষ্ট্রীয় প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা যায়, তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে পরিবহন সেক্টরের নানা স্তরে চলমান চাঁদাবাজির চালচিত্র সবিস্তারে উঠে এসেছে। প্রতিদিন এ সেক্টরের নানা পর্যায়ে অন্তত ২০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি ঘটে থাকে। এ চাঁদার প্রায় অর্ধেক অংশই হাতিয়ে নেয় পরিবহন সেক্টরের মাফিয়া খ্যাত পাঁচ গডফাদার। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় পর্যায়ের আরও অর্ধশতাধিক চাঁদাবাজ নেতা দৈনিক হারে চাঁদা ভাগবণ্টন করে নেয়। চাঁদার অবশিষ্ট প্রায় ৭ কোটি টাকা মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী সিন্ডিকেট সদস্যরা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য নিজেদের পকেটস্থ করেন। পরিবহন সেক্টরের সর্বস্তরে বিরাজমান অপ্রতিরোধ্য চাঁদাবাজির ভয়ংকর অপরাধ রীতিমতো সাংগঠনিকভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, রাজধানীসহ সারা দেশে ৬৮৬টি অবৈধ সংগঠন সর্বত্র প্রকাশ্যে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে। এ ছাড়া নানা কৌশলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদন নেওয়া ১৮টি সংগঠনও বহুমুখী চাঁদাবাজি চালিয়ে থাকে। চাঁদাবাজিকে পরিবহন সেক্টরের সবচেয়ে বড় সমস্যা উল্লেখ করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, পরিবহন খাতের কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি নির্বিঘ্ন করতে সর্বদলীয় নানা সাংগঠনিক ফোরাম গড়ে তোলা হয়েছে। পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের কাছে এই চাঁদাবাজ ফোরামগুলো ‘সিন্ডিকেট’ নামেই সমধিক পরিচিত। এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সবাই রাজনীতি করেন। সেখানে বামপন্থি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত, জাপা সবাই আছে। চাঁদার বিষয়ে তারা সবাই এক। এ ছাড়া আছে ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের চাঁদাবাজি। এই চাঁদাবাজির টাকা আদায়ের পুরো চাপ গিয়ে পড়ছে সাধারণ যাত্রীদের ওপর। বেপরোয়া চাঁদা আদায়ের কারণে দফায় দফায় বাসভাড়া অযাচিতভাবে বাড়ানো হয়। যাত্রীদের কষ্টে অর্জিত টাকা নিয়ে পরিবহন নেতারা অঢেল সম্পদ গড়ে তুলে আলিশান জীবন-যাপন করছেন। পরিবহন মালিকদের অভিযোগ, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আওয়ামীপন্থি ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে বিএনপি-জামায়াত হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের নিয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। জামায়াত-বিএনপির এই সিন্ডিকেটটি বেপরোয়া চাঁদাবাজি চালালেও টুঁ-শব্দটি করার সাহস কারও নেই। সাধারণ মালিকদের অভিযোগ, অতিরিক্ত চাঁদা আদায়ের ফলে তারা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবহন মালিক সমিতির এক সদস্য বলেন, ‘যেভাবে চাঁদাবাজি হচ্ছে, মালিক-শ্রমিকের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। গাড়ি চালানোর মতো কোনো অবস্থা নেই।’
এর আগে শ্রম মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে শ্রমিক-মালিক সংগঠনগুলোর দেওয়া ১৭ দফা সুপারিশে বলা হয়েছে, শ্রমিক-মালিক সংগঠন পরিচালনার ব্যয় বাবদ বহিরাগত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীদের সহায়তায় মাত্রাতিরিক্ত চাঁদা আদায় হচ্ছে। চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য অবৈধ সংগঠনগুলোর কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করার পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব ও হস্তক্ষেপ বন্ধ করার জোর দাবি জানানো হয়। জাতীয় স্বার্থেই সড়ক পরিবহন সেক্টরের সব ধরনের অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, নিবন্ধিত সংগঠনগুলো কী পরিমাণ চাঁদা আদায় করতে পারবে তাও নির্ধারণ করে দিতে হবে। কোনো সংগঠন নিয়মবহির্ভূত অতিরিক্ত চাঁদা আদায় করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবৈধ চাঁদা বন্ধে মালিক, শ্রমিক, বিআরটিএ ও পুলিশ প্রশাসনে সর্বোচ্চ নজরদারি প্রয়োজন। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন দাখিল হতেই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পরিবহন সেক্টর জঞ্জালমুক্ত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নের এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সমন্বিত অভিযান চালানোর প্রস্তুতি চলছে বলেও আভাস পাওয়া গেছে।