সুপ্রভাত নামে যাত্রীবাহী বাসটি নর্দ্দা অতিক্রম করছিল। হঠাৎ দুটি মোটরসাইকেলে চার ব্যক্তি বাসের সামনে এসে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়ায়। চালক বাসটি থামিয়ে দেয়। মোটরসাইকেলে আসা চারজনের মধ্যে তিনজন দ্রুত বাসে উঠে যায়। তারা বাসটি সাইড করতে বলে। তাদের একজনের হাতে ওয়্যারলেস সেট। দুজনের পরনে ডিবি লেখা জ্যাকেট। বাসের যাত্রীদের মধ্যে কাউকে খুঁজছিলেন তারা। যাত্রীরা বিরক্ত। কেউ একজন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার ভাই! বাস থামিয়ে রেখেছেন কেন?’ এ কথা বলতেই তিনজনের একজন বলে ওঠেন, ‘আমরা পুলিশের লোক। এ বাসে একজন মাদক ব্যবসায়ী আছে। আপনারা আমাদের সাহায্য করবেন।’ যাত্রীরা বলেন, যদি এমন কেউ থাকে, আমরা অবশ্যই সাহায্য করব। পুলিশের তিনজন যাত্রীদের সিটের কাছে গিয়ে খোঁজ করতে থাকেন। তারা মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক যাত্রীর সিটের কাছে এসে থেমে যান। তারা মোস্তাফিজুর রহমান ও তার বন্ধুর উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য আছে তোরা ইয়াবা খাস, তোদের কাছে ইয়াবা আছে। তোরা মাদক ব্যবসায়ী। চল আমাদের সঙ্গে।’
এ কথা বলে তারা মোস্তাফিজুর রহমান ও তার বন্ধুকে জোরপূর্বক বাস থেকে নামিয়ে আনেন। যাত্রীরা পুলিশকে বাধা দেননি।
এরপর তাদের দুজনকে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মারেন এবং মোস্তাফিজুর রহমানের পকেটে থাকা নগদ ৪২ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল ফোন সেট এবং তার বন্ধুর কাছে থাকা নগদ ১৫ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন সেট জোর করে ছিনিয়ে নেন। মোস্তাফিজের বন্ধুর পকেটে তল্লাশি করেন। কিন্তু ইয়াবা বা অন্য কোনো মাদক খুঁজে পান না। তাকে ছেড়ে দেন। পরে মোস্তাফিজের হাতে থাকা ব্যাগে ইয়াবা আছে বলে তারা চ্যালেঞ্জ করেন। মোস্তাফিজ অস্বীকার করেন। কিন্তু পুলিশ দল মোস্তাফিজকে বলে, ‘চল থানায়। সেখানেই তল্লাশি হবে।’ মোস্তাফিজ তাতে রাজি হন। মোস্তাফিজ তাদের মোটরসাইকেলে চড়ে বসেন। মোস্তাফিজকে থানায় নিয়ে মামলা দেওয়ার কথা বলে গুলশান, বাড্ডা, হাতিরঝিল এলাকায় ঘুরতে থাকেন। ঘুরতে ঘুরতে রাত বাড়ে। তারা যখন ঢাকা শহর ঘুরতে ঘুরতে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় আসেন, তখন রাত সাড়ে ৩টা। বিএসটিআই মোড়ে এনে তারা মোস্তাফিজকে বলেন, ‘তোকে আজকের মতো ছেড়ে দিলাম। তুই আর ইয়াবা খাবি না।’ এ সময় তারা তার কাছ থেকে টানাটানি করে তার ব্যাগটি নেওয়ার চেষ্টা করেন। ব্যাগে মোস্তাফিজের ব্যবসার ১৩ লাখ টাকা ছিল। একপর্যায়ে মোস্তাফিজ বুঝতে পারেন তারা পুলিশ নন। তখন তিনি ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। এ সময় পুলিশের দল ব্যাগটি ছেড়ে দিয়ে মোটরসাইকেলযোগে দ্রুত পালিয়ে যায়। পরে মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা (নম্বর ৩১) দায়ের করেন। মামলাটি পিবিআই তদন্ত করে। তারা বের করে আনে আসল তথ্য। পিবিআই জানতে পারে, তারা পুলিশ নয়। পুলিশ পরিচয়ধারী অপরাধী। পিবিআই জানায় ‘পুরান ঢাকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকরা এ চক্রের সোর্স। তারা তথ্য দিতেনÑ কোন ব্যবসায়ী কত টাকা নিয়ে ফেরত যাচ্ছেন। তথ্যানুযায়ী ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে থেকে অনুসরণ করা হতো। এরপর অন্য এলাকায় যাওয়ার পর কখনো মোটরসাইকেল, কখনো মাইক্রোবাসে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে সবকিছু কেড়ে নিত। তারা ডাকাতি থেকে প্রাপ্ত অর্থের ৪০ ভাগ সোর্সদের দিত।’ এ ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় ডিবির ইন্সপেক্টর পরিচয়দানকারী জাবেদ আহমেদ ওরফে বাবু (৩৭) ও সোহাগ খন্দকার (৩১), উপপরিদর্শক পরিচয়দানকারী নাজমুল হোসেন (২৪) ও দেলোয়ার হোসেন (৫০), কনস্টেবল পরিচয়দানকারী আসাদুজ্জামান (৩৫), বুলবুল আহমেদ (৩২), হারুন ওরফে হীরাকে (৩২)। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে চারটি মোটরসাইকেল, তিনটি ওয়্যারলেস, এক জোড়া হ্যান্ডকাফ, খেলনা পিস্তল দুটি, চাপাতি একটি, একটি চাকু উদ্ধার করা হয়। পরে গ্রেফতার হন দলের প্রধান এ কে এম রানা। নিজেকে ডিবির এএসপি (এসি) পরিচয় দেন তিনি। দীর্ঘ অনুসন্ধান ও অভিযানের পর তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। জিজ্ঞাসাবাদে রানা পিবিআইকে জানিয়েছেন, বলিউডের হিন্দি সিনেমা ‘বস’ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সংঘবদ্ধ এ চক্রটি গড়ে তোলেন তিনি। নিজেই দলের বস সেজে পুলিশ পরিচয়ে বিভিন্ন এলাকায় এভাবে ডাকাতি করেন। সিনেমার নায়ককে বসরূপে দেখে অনুপ্রাণিত হলেও এরা নায়ক হতে পারেননি, হয়েছেন খলনায়ক। পুলিশ জানায়, এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি দেখলে অবশ্যই পুলিশকে খবর দিতে হবে। তা ছাড়া ৯৯৯-এ কল করলেও তৎক্ষণাৎ পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হবেন।