বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

বকেয়ার দাবিতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিক্ষোভ

বিজিএমইএর আশ্বাসে প্রত্যাহার

নিজস্ব প্রতিবেদক

বকেয়ার দাবিতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিক্ষোভ

বাংলাদেশে করোনার ভয়াবহতা বাড়ছে। করোনা প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সাধারণ মানুষকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না সরকার। এরই মধ্যে হাজার হাজার শ্রমিক বকেয়া বেতনের দাবিতে ঝুঁকি নিয়ে সড়কে নামছেন। গতকালও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা ও গাজীপুরে বকেয়া বেতন  পরিশোধের দাবিতে সড়কে বিক্ষোভ করেছেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা। পরে সংশ্লিষ্ট গার্মেন্ট মালিকদের আশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রমিকদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয় পুলিশ। মহামারী ছড়ানো ঠেকাতে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। বেশির ভাগ গার্মেন্ট এখন বন্ধ রয়েছে। তবে সরকার এরই মধ্যে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতনের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে মালিকদের। গার্মেন্ট শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধে সরকার ঘোষিত পূর্ব নির্ধারিত সময় শেষ হচ্ছে আজ (বৃহস্পতিবার)। শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা না হলে অভিযুক্ত গার্মেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।

ঢাকা : গতকাল সকাল থেকে ঢাকার আশুলিয়া, উত্তরা, বাড্ডা, ভাটারা, মিরপুর, ভাষানটেক, শাহআলী, তেজগাঁও, মতিঝিল এলাকায় শত শত শ্রমিক বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। পরে সংশ্লিষ্ট কারখানার মালিকদের আশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রমিকদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয় পুলিশ। আশুলিয়ায় এসএমএস গার্মেন্টের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। দক্ষিণখানের হাজী রোডে স্যার ডেনিম গার্মেন্টের শ্রমিকরা সামনের রাস্তায় অবস্থান করে বিক্ষোভ করেছেন। প্রগতি সরণি এলাকায় শমসের রাজিয়া নামে একটি গার্মেন্টের শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। মালিকের সঙ্গে কথা বলে ২০ এপ্রিল বেতন পাওয়ার আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তারা রাস্তা ছাড়েন বলে জানিয়েছে বাড্ডা থানা পুলিশ।

ভাটারা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু আজিফ জানান, সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত কুড়িল এলাকার ক্লাসিক গার্মেন্টের শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। তারা ২০ এপ্রিলে বেতন পাওয়ার আশ্বাসে রাস্তা থেকে সরে যান। কল্যাণপুরে একটি গার্মেন্টের কর্মীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছিলেন। দারুস সালাম এলাকার এমইসি গার্মেন্ট শ্রমিকরা গাবতলী এলাকায় অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন। মিরপুর-১০ নম্বরে শাকিব গার্মেন্টের শতাধিক কর্মী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। কাফরুল এবং ভাষানটেকের মাঝামাঝি কচুক্ষেত এলাকার চিটাগাং গার্মেন্টের শ্রমিকরাও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। মিরপুর ২ নম্বরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের সামনে স্থানীয় ছোট ছোট কয়েকটি গার্মেন্টের প্রায় দেড়শ শ্রমিক রাস্তায় অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন। শাহ আলী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জানান, কয়েকজন মালিকের সঙ্গে কথা বলে তারা খুব শিগগরিই বেতন দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলে শ্রমিকরা চলে যান। কারওয়ান বাজারের কাঠপট্টিতে ডিজাইন অ্যান্ড সোর্স নামে একটি গার্মেন্ট শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন বলে জানান তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (অপারেশন) হাসনাত খন্দকার। তিনি বলেন, মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর শ্রমিকদের বুঝিয়ে গার্মেন্টের ভিতরে নেওয়া হয়। দক্ষিণ কমলাপুরে বিন্নি গার্মেন্ট এবং সরদার নিট অ্যান্ড ওয়্যার নামে অপর একটি গার্মেন্টের দুই শতাধিক শ্রমিক কমলাপুর এলাকার সড়কে অবস্থান নেন। তারা বেতন-ভাতার জন্য বিক্ষোভ করেন। মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনির হোসেন বলেন, এই দুটি গার্মেন্টের অবস্থান প্রায় কাছাকাছি।

গাজীপুর : বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে গাজীপুরে বিভিন্ন গার্মেন্ট শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। পরে কর্তৃপক্ষের আশ^াস পেয়ে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ তুলে নেন। কয়েকটি স্থানে শ্রমিকদের অবরোধ তুলে নিতে পুলিশের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) সদর থানার ওসি মো. আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া জানান, বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে সিটি করপোরেশনের তিন সড়ক এলাকার স্টাইলক্রাফট ও ইন্টারম্যাক্স গার্মেন্টের শ্রমিকরা গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা কারখানার সামনে ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে অবস্থান নেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কারখানার মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে। পরে ইন্টারম্যাক্স কারখানার কর্তৃপক্ষ ২০ এপ্রিল এবং স্টাইলক্রাফট কর্তৃপক্ষ ২৭ এপ্রিল বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নেন। এদিকে, সকালে সিটি করপোরেশনের সালনা এলাকার শ্যামলী গার্মেন্টের শ্রমিকরা কারখানা সংলগ্ন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে শ্রমিকদের বুঝিয়ে এবং মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। শিল্প পুলিশের ইন্সপেক্টর আসাদুজ্জামান জানান, একই দাবিতে সিটি করপোরেশনের ভোগড়া বাইপাস সড়ক অবরোধ করে ভিঅ্যান্ডআর ফ্যাশনের শ্রমিকরা, সাইনবোর্ড এলাকায় আসোকা কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

শ্রমিকদের অভিযোগ, মহামারী করোনা আতঙ্ক নিয়েও কাজ করে বেতন না দিলে আমরা খাব কী, আমাদের চলার কোনো উপায় নেই। গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, সকালে জেলার বিভিন্ন গার্মেন্টের বেতন পরিশোধের দাবি নিয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করে। পরে মালিকপক্ষ বেতন পরিশোধের আশ^াস দিলে তারা নিভৃত হয়। এদিকে, গতকাল সকাল থেকে গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক এলাকায় বু ফ্যাশন লি., আটলান্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লি., শিশির লি., আলিফ ট্রেসার, মদিনা ওয়াসিং লি., ওরিয়েট লি. নামক কারখানার কয়েকশ শ্রমিক বিক্ষোভ করেন। এরপর দুপুর ১২টায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের স্টেশন রোড এলাকার দুই পাশে ঘণ্টাব্যাপী অবরোধ করেন।

এ সময় রাস্তায় যানজট লেগে যায়। শ্রমিকরা জানান, টানা কয়েক সপ্তাহ ছুটি চলছে। পূর্ব নির্ধারিত ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল বেতন দেওয়ার কথা থাকলে সকালে কারখানার মূল ফটকে বন্ধের নোটিস দেখতে পেয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বেতনভাতা পরিশোধ করা হবে।

চট্টগ্রাম ইপিজেড : বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করেছেন। পদ্মা ওয়্যারস লিমিটেড নামে ওই পোশাক কারখানার শ্রমিকরা এ সময় তাদের দাবি আদায়ে সড়কে বিক্ষোভও করেন। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ফ্রি পোর্ট-ইপিজেড এলাকায় শ্রমিকরা এই অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।

এদিকে বিজিএমইএ-চট্টগ্রামের সচিব মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন জানান, দু-এক দিনের মধ্যে সব পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য তারা মালিকপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন। সরকারও শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করে প্রণোদনা দিয়েছে। ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন,  শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে ইপিজেড এলাকার প্রধান সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছিলেন। মালিক পক্ষ ১৮ এপ্রিল বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিলে তারা অবরোধ তুলে নেন।

বিজিএমইএর আশ্বাসে প্রত্যাহার : এখনো মার্চ মাসের বেতন না পাওয়া পোশাক কারখানার শ্রমিকদের আগামী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেছেন মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক। তিনি বলেছেন, একজন শ্রমিকও বেতন ছাড়া থাকবেন না। এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমাদের ৫ থেকে ৭ দিন একটু সময় দিন। কারণ ব্যাংক থেকে অর্থছাড়ে সমস্যা হচ্ছে। বিজিএমইএর তথ্য বলছেÑ গতকাল বিকাল পর্যন্ত তাদের সদস্য ২ হাজার ২৭৪টি কারখানার মধ্যে ১ হাজার ১৮৬ কারখানার প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক বেতন পেয়েছেন। আর বেতন পাননি ১ হাজার ৮৮ কারখানার ৫ লাখ ৫২ হাজার ৮১৭ জন পোশাক শ্রমিক।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতিÑবিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক গতকাল বিকালে অডিও বার্তায় বলেন, আমাদের প্রায় ৭৮ শতাংশ শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। আশা করছিÑ আগামীকালের (আজ) মধ্যে ৮০ শতাংশ হয়ে যাবে। কিন্তু বাকি যে শ্রমিকেরা থাকবেন, তাদের জন্য এই মুহূর্তে চেষ্টা করব, আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যে বেতন পরিশোধ করার। শ্রমিক তো শ্রমিকই। কারণ যখন একজন শ্রমিক রাস্তায় নামেন, তখন তিনি কোন কারখানার শ্রমিক কিংবা ওই কারখানা বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ সদস্য সেটা দেখার বিষয় নয়। সেই দায়বদ্ধতা থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে আবেদন করেছি। ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোতে ব্যাংকিং সমস্যা আছে। তাদের দেরি হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে বিজিএমইএ সাহায্য করবে। ছোট, বড় ও মাঝারি সব কারখানাই এক। তাই গণমাধ্যম ও ব্যাংকের সহায়তায় উদ্যোক্তাদের বলে যত তাড়াতাড়ি পারি বেতন দেব।

বিজিএমইএ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেÑ দেশের প্রধান এই রপ্তানি খাতের ১ হাজার ১৮৬টি কারখানার মালিকরা তাদের ১৯ লাখ ১৯ হাজার ৬০০ শ্রমিককে বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছেন। ফলে বিজিএমইএ সদস্য কারখানার ৭৮ শতাংশ শ্রমিক বেতন পেয়েছেন। বিজিএমইএ সদস্য ২ হাজার ২৭৪ কারখানায় মোট ২৪ লাখ ৭২ হাজার ৪১৭ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৩৭২টি কারাখানার মধ্যে ২০১টি, গাজীপুরের ৮১৮টি কারখানার মধ্যে ৪৩২টি, নারায়ণগঞ্জ এলাকার ২৬৯টি কারখানার মধ্যে ১১৮টি, সাভার ও আশুলিয়ায় ৪৯১টি কারখানার মধ্যে ২৪৩টি, চট্টগ্রামে ৩২৪টি কারখানার মধ্যে ১৫৬টি এবং দেশের প্রত্যন্ত এলাকার ৪২টি পোশাক কারখানার মধ্যে ৩৬টি পোশাকশিল্প কারখানার মালিক সর্বমোট ১৯ লাখ ১৯ হাজার ৬০০ জন শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছেন। যদিও আজ ১৬ এপ্রিলের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পোশাক মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ।

সর্বশেষ খবর