বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হাটবাজার

নিজামুল হক বিপুল

করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হাটবাজার

চট্টগ্রামে লকডাউনের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে যানবাহন, ফলে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকিতে নগরবাসী। ছবিটি স্টেশন রোড থেকে গতকাল তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনাভাইরাসের আক্রমণের চতুর্থ ধাপের প্রথম ঢেউয়ে আছে বাংলাদেশ। এ সময়ে এসে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ থেকে মানুষে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর সারা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। ৬৪ জেলার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৫৫ জেলায় কভিড-১৯-এর রোগী শনাক্ত হয়েছে। বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক লোকের মধ্যে করোনার সংক্রমণ হচ্ছে হাট-বাজার থেকে। সংক্রমণ ঠেকাতে ইতিমধ্যে বড় বাজারগুলোকে খোলা মাঠে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তবে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। এখনো বাজারগুলোতে ভিড় লেগেই আছে। সুপার শপগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ভিতরে প্রবেশ করার পর সেই দূরত্ব আর থাকছে না। সব মিলিয়ে বাজারই হচ্ছে এখন সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সংক্রমণের হার বাড়তেই থাকবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। দফায় দফায় ছুটি বৃদ্ধি করে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখন আবারও ছুটির মেয়াদ আরেক দফা বাড়িয়ে আগামী ৬ মে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ সময়ে অতি জরুরি কাজ ছাড়া মানুষকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছে সরকার। তবে জরুরি সেবাপ্রতিষ্ঠান ও সার্ভিসগুলো এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে। কিন্তু ঘর থেকে বের হতে সরকার বারবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে প্রতিদিন রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে ভিড় করছেন মানুষ। এ ছাড়া দেশের বড় শহরগুলোতে মানুষ দিব্যি বাজারে যাচ্ছেন এবং কোনোরকম দূরত্ব বজায় না রেখেই তারা কেনাকাটা করছেন।

বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতিপূর্বে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে সারা দেশের জেলা প্রশাসক (ডিসি), জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের চিঠি দিয়ে গ্রামীণ হাট-বাজারকে খোলা মাঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই নির্দেশের পর দেশের অনেক জায়গায় হাট-বাজারকে খোলা মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে সেসব বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতারা কতটা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন তা খুব একটা মনিটরিং হচ্ছে না বলে স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

অন্যদিকে দেশের বড় বাজারগুলোকে, যেসব বাজারে খুব বেশি মানুষের সমাগম হয় সেসব বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভা থেকে এ নির্দেশনা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনার পর তৎপর হয়ে ওঠে পুলিশ। বিশেষ করে রাজধানীর কাঁচাবাজারের সবচেয়ে বড় আড়ত কারওয়ান বাজার থেকে খুচরা বিক্রেতাদের সরিয়ে তেজগাঁও বিজ্ঞান কলেজের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুধু পাইকারি বিক্রেতাদের কারওয়ান বাজারে কেনাকাটা ও বেচাবিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু কারওয়ান বাজার থেকে খুচরা বিক্রেতাদের সরিয়ে দেওয়া হলেও রাজধানীর অন্য বাজারগুলো, যেমন মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, পুরান ঢাকার বাবুবাজার, যাত্রাবাড়ী পাইকারি বাজারসহ এ রকম আরও অনেক বাজার রয়েছে যেগুলোতে সকাল থেকেই ভিড় লেগে যায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের। এসব বাজারে সামাজিক দূরত্ব মানার ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই খুব একটা গুরুত্ব দেন না। শুধু রাজধানী নয়, ঢাকার বাইরে সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া, রংপুর, ময়মনসিংহসহ বড় শহরগুলোতেও কাঁচাবাজারে একই অবস্থা বিরাজ করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের চূড়ান্ত পর্বে পা রাখা বাংলাদেশকে ব্যাপক সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে বাজারগুলোতে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এখন করোনা পেনডামিকের চতুর্থ ধাপের প্রথম ঢেউয়ে আছি। এ অবস্থায় এর সংক্রমণ ঠেকাতে এখন আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।’ তিনি বলেন, বাজারগুলোকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ বাজারগুলো হচ্ছে সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কেন্দ্র। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সিটি করপোরেশনের লোকজন বাজার কমিটির সঙ্গে বসে বাজারকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করবে। সময় নষ্ট করা যাবে না। বাজারে একসঙ্গে কত লোক ঢুকতে পারবে তাও নির্ধারণ করে দিতে হবে। এক গ্রুপ বের হওয়ার পর অন্য গ্রুপ ঢুকবে এবং সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কেনাকাটা করবে। সেটি হচ্ছে কি না তাও মনিটরিং করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন হলে বাজারের একটি প্রবেশপথ ও একটি বাহিরপথ নির্ধারণ করে দিতে হবে।

ডা. মুশতাক বলেন, বাজারে যারা যাচ্ছেন প্রবেশের সময়ই তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। যদি কারও শরীরে জ্বর পাওয়া যায় তাহলে তাকে সরিয়ে নিতে হবে এবং তাকে বাসায় আলাদা থাকার জন্য বলতে হবে। তার স্যাম্পল কালেকশন করতে হবে। তার নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করতে হবে। টেস্ট করার পর তার ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি বলেন, বড় সুপার শপগুলোতে লোকজন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে কি না সেদিকে নজর দিতে। প্রয়োজনে সুপার শপগুলোতে ভলান্টিয়ার রাখতে হবে। আর রাজধানী এবং বড় শহরে লোকসমাগম হয় এমন বাজারগুলোকে বড় বড় সড়কে নিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই সংক্রমণ ঠেকানোর। তিনি বলেন, যেসব এলাকায় করোনভাইরাসের ক্লাস্টার রয়েছে সেখানকার বাজারগুলোতে সর্বোচ্চ কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী চিকিৎসক ফেরদৌস খন্দকার বলেন, ‘এ মুহূর্তে বাজার নিযন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ বাজার থেকেই আপনার বা আপনার পরিবারের অন্য কারও শরীর হয়ে করোনাভাইরাস আপনার ঘরে ঢুকে যাবে।’ তাই যতদূর সম্ভব বাজার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আগামী ১৫ দিন আপনি বাজারে না গিয়ে শুকনো খাবার খেতে পারেন, যেগুলোর জন্য কাঁচাবাজারে যেতে হবে না।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর