কয়েকদিন বাদেই ঈদুল আজহা। কিন্তু ঈদের আনন্দ নেই ২১ জেলার ৩০ লক্ষাধিক বানভাসি মানুষের মনে। শিশু, বৃদ্ধ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি নিয়ে কারও দিন পার হচ্ছে উঁচু সড়ক ও বাঁধের ওপর খোলা আকাশের নিচে। কারও ঠাঁই হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে। কেউ নদীভাঙনে হারিয়েছেন শেষ সম্বল ভিটেমাটি। কেউ আবার পরিবার নিয়ে নৌকায় করে ভাসছেন দিনের পর দিন। টানা বন্যার পানির সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে নানা রোগে আক্রান্ত বানভাসিরা। নেই পর্যাপ্ত খাবার। নেই বিশুদ্ধ পানি। নেই রান্নার ব্যবস্থা। কোরবানির ঈদে বেশি দামে বিক্রির স্বপ্ন নিয়ে এক বছর ধরে পরম যতেœ লালন-পালন করা গরিব কৃষকের পশুটিও যত্ন আর পশুখাদ্যের অভাবে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। মিলছে না কাক্সিক্ষত দাম। এর মধ্যেই অনেক জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হচ্ছে। সব মিলে করোনার মধ্যে টানা বন্যা দুঃস্বপ্ন হয়ে হাজির হয়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জীবনে। কেড়ে নিয়েছে ঈদের আনন্দ। গত দুই দিন ধরে কয়েকটি নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও এখনো বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে গ্রামের পর গ্রাম। লাখ লাখ ঘরছাড়া মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর মধ্যেই বেশ কিছু নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে ঈদের আগে বন্যা থেকে মুক্তির আশা নেই বললেই চলে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, গতকাল সকালেও ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের ৪৩টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। ১৭টি নদ-নদীর পানি ২৭টি স্টেশনে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল সকালের বুলেটিনে বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। এ ছাড়া আজকের মধ্যে গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে তবে ঢাকা জেলার আশপাশের নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আজকের মধ্যে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়া, জামালপুর সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাঈল এবং নওগাঁ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- কুড়িগ্রাম : বন্যার কারণে নদীভাঙনে কুড়িগ্রামের ছয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের হুমকিতে আছে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান। এদিকে ধরলা নদীর পানি সামান্য কমলেও ব্রহ্মপুত্র নদসহ সবকটি নদ-নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরপর দুই দফা বন্যার ধকল শেষ হতে না হতেই তৃতীয় দফা বন্যার কবলে পড়েছে জেলার নদ-নদী অববাহিকার সাড়ে তিন লক্ষাধিক মানুষ। দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় নাকাল কুড়িগ্রামের সাড়ে চার শতাধিক চর ও দ্বীপচরসহ নদীপাড়ের এসব মানুষ। উঁচু সড়ক, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছেন বানভাসিরা। জেলার ৯ উপজেলার ৯১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লক্ষাধিক পানিবন্দী মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। গাদাগাদি করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পাঁচগাছী হাইস্কুলে অবস্থান নেওয়া বানভাসি মিজানুর জানান, আমার বাড়িতে প্রায় এক বুক পানি। প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টে স্কুলে উঠে দিন কাটাচ্ছি। আমাদের ঈদ নেই। বেঁচে থাকাই এখন দুষ্কর। গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গাইবান্ধা জেলা শহরের পার্শ্ববর্তী কূপতলা, খোলাহাটি, ঘাগোয়া, গিদারি, মালিবাড়ি ইউনিয়নের নিচু এলাকাগুলোতে বসতবাড়ি ও সড়কে পানি উঠে পড়েছে। সেই সঙ্গে গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, উপজেলায় নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঐতিহ্যবাহী পুরাতন দুর্গামন্দিরসহ ৫০টি বসতবাড়ি ও সংলগ্ন জমি এবং গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কামারজানি বন্দর, মার্চেন্ট হাইস্কুলসহ ৫০০ পরিবারের বসতবাড়ি ও আবাদি জমি এখন ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে।
রাজবাড়ী : পদ্মা নদীর পানি আবার বাড়তে থাকায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রথম দফার পানি বৃদ্ধির রেকর্ড ভেঙে গতকাল সকালে পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমার ১১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে করে জেলার সদর, গোয়ালন্দ, পাংশা ও কালুখালী উপজেলার প্রায় ৭০ হাজার মানুষ নতুন করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। মানুষ যেসব রাস্তায় পানি ওঠেনি সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। গবাদি পশু নিয়ে রাস্তার পাশে অবস্থান করায় ডাকাত আতঙ্কে ভুগছেন বানভাসিরা। রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক দিসলাস বেগম জানান, বন্যায় কবলিত মানুষের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৭০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বিতরণের কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে সব দুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হবে। নাটোর : সিংড়া নলডাঙ্গায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আত্রাই নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন করে অসংখ্য বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। সহস্রাধিক মানুষ ২০টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে অন্যের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়ে দিনাতিপাত করছেন। বন্যায় সিংড়া উপজেলা সদরের থানা মোড়, সাবরেজিস্টার অফিস, কাঁচাবাজার, গোডাউন পাড়ায় পানি ঢুকে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় জেলাজুড়ে নিম্নাঞ্চলে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। শরীয়তপুর : জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার চারটি ইউনিয়নে পদ্মা নদীতে এবং নড়িয়া-সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে কীর্তিনাশা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে ভাঙনে প্রায় দুইশ পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, নদীর তীর উপচে জেলার নড়িয়া, জাজিরা, শরীয়তপুর সদর ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে ৩০০টি গ্রাম এখন প্লাবিত। এতে অন্তত ৫০ হাজার পরিবার ও দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গ্রামগুলোতে খাওয়ার পানি, রান্নার জ্বালানি ও গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বগুড়া : যমুনা নদীতে বিপৎসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার ও বাঙালী নদীতে ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ঘরবাড়িতে পানি উঠে যাওয়ায় বানভাসিরা আশ্রয় নিয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কিংবা আশ্রয়ণ কেন্দ্রে। বন্যায় বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার তেকানীচুকাইনগর ও পাকুল্লা ইউনিয়নের চরাঞ্চলের গৃহহীন মানুষের জন্য উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁবু স্থাপন করা হচ্ছে।